ইনসানে কামিল

– ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান

চার ঈমামের গবেষণা- কিয়াস ও ফিকাহ শাস্ত্র

 

জগৎবাসী মানুষের জন্য পবিত্র কোরআন হলো আল্লাহর প্রেরীত শরীয়তের বিধান ও হেদায়েত নামা। আল্লাহ পাক এই পবিত্র কালাম তাঁর প্রেরীত রাসুল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)- এর উপর আরবী ভাষায় নাজিল করেছেন। আরবী ভাষা আল্লাহর পছন্দনীয় ভাষা। অত্যন্ত রহমত ও বরকত পূর্ণ ভাষা। তাই কোরআনে পাক পাঠ করলে মানুষের অন্তর রৌশন দীপ্ত হয়। অর্থ বুঝে পাঠ করে সেই অনুসারে আমল করতে পারলে অন্তর অধ্যাত্মিক জ্ঞান ও মারেফাতে পূর্ণ হয়ে যায়।
রাহমাতুল্লিল আলামীন সাইয়েদুল মোরছালীন মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- কে মহান আল্লাহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকার জ্ঞানে গুনান্বিত করেই সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহ পাকের দাওয়াত, নবুয়ত, রেসালাত এবং মানুষ জাতির প্রতি আল্লাহর নির্দেশাবলী শত বাঁধা বিপত্তি, যুদ্ধ বিগ্রহ, নির্মম অত্যাচার, ত্যাগ তিতীক্ষা এবং শহীদদের তরতাজা রক্তের বিনিময়ে বেঈমান মোশরেক পৌত্তলিকদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন পবিত্র কোরআন তথা পুর্ণ ইসলামী জীবন বিধান। আর এ ভাবেই নবীর জীবন থেকে বয়ে গেছে ২৩টি বৎসর।
আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছেন-

“হে আমার উম্মতগণ! আমি তোমাদের ছেড়ে দুনিয়া হতে চলে যাচিছ। কিন্তু তোমাদের জন্য রেখে যাচিছ আল্লাহ পাকের পবিত্র কোরআন এবং আমার হাদীস (সুন্নাহ)। একে তোমরা শক্ত ভাবে ধরে রেখো। তা হলে তোমরা পথ ভ্রষ্ট হবে না।”

নবী করিম (সাঃ)- এর ইস্তেকালের পর তাঁর আসহাবে হাজেরীন, তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈন, আইম্মায়ে মোস্তাহেদীন, ওলামায়েকেরামগণ এবং ভক্ত-বৃন্দ দাওয়াতের কাজ পর্যায়ক্রমে করে যাচেছন। আল্লাহর ইচছায় এই দাওয়াতের কাজ কেয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে।
তবে নবী করিম (সাঃ) এর জীবদ্দশায় তিনির জবানে আল্লাহ পাকের কালাম পাঠ ও তার ব্যাখ্যা এবং বর্ণণা শুনে এলমে দ্বীন তথা ইসলামী শরীয়তের বিষয়বস্তু স¤পর্কে জ্ঞান হাসিল করা যতটা সহজ সাধ্য ছিলো এখন ততটা সহজ সাধ্য নয়। রাসুলে করিম (সাঃ)- এর নূরানী চেহারা মোবারক দর্শনে মানুষের আÍবিশ্বাসের যে ভীত তৈরী হতো, তাঁর কথা শুনে যত তাড়াতাড়ি ইসলামের আইন কানুন হৃদয়ঙ্গম করা যেতো- আজ তা কি করে সম্ভব?
রাসুলের (সাঃ) মৃত্যুর পর একে একে গত হয়েছে আসহাবে হাজেরীন, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনের যুগ। তারপর এসেছে আইয়ামে মুসতাহিদীন, ওলামায়েকিরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের যুগ। এর মধ্যেই তখনকার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী আলেমে হক্কানী, কুতুবে রাব্বানী চার জন মহা মনীষী ইমাম আল্লাহর ইচছায়, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে ইসলামী শরীয়তের বিধান সমূহের কঠিন কঠিন বিষয় সমূহ আরও সহজ সরল পন্থায় পালন করা যায় কিনা এ বিষয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে ইচছা প্রকাশ করেন, যাতে সর্ব সাধারণের জন্য ইসলামের নিয়ম কানুন বুঝতে, শিখতে ও আমল করতে সহজ সাধ্য হয়।
আল্লাহ পাক মহা বৈজ্ঞানিক। তাঁর সব কাজই প্রজ্ঞাময়। কুদ্রতে কামেলায় আল্লাহ পাক যাকে যে জ্ঞান দান করেছেন একমাত্র সে-ই সে বিষয়ে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তা না হলে, আল্লাহ পাকের কুদ্রতে কামেলা ও হিকমত সম্বন্ধে মানুষ কিছুই জানত না।
আজ চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে মানুষ অনেক কিছুই জানতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে। আজকের যত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি সব কিছু এই চিন্তা ও গবেষণার ফসল।
তবে এ সব নিয়ে গবেষণা করা আর কোরআন, হাদিস ও শরিয়তের আইন কানুন নিয়ে গবেষণা করা এক জিনিস নয়। এ গবেষণা পবিত্র কোরআন এবং রাসুলের (সাঃ) হাদীস অনুসারে হতে হয়।
মহান আল্লাহর মেহেরবাণীতে চার ঈমামের কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের জন্য কোরআন ও সুন্নার আলোকে আমরা ফেকাহ শাস্ত্র লাভ করেছি। এই ফেকাহশাস্ত্রই হলো ইসলাম ও শরিয়তের বিধানে মুসলানগণের জন্য একটি ফয়সালা সূচক পথ।
যে সব বিষয় কোরআন ও হাদীসের আলাকে সহজ ভাবে বুঝা যায় নাই, সে সব বিষয়ে আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের মাধ্যমে তারা নিজ জ্ঞান, সৎ চিন্তা ও কিয়াসের সাহায্যে মীমাংসা করে গেছেন। এই চার ঈমাম ছাড়াও শরিয়তের বিভিন্ন বিষয়ের উপর কয়েক জন মুস্তাহেদীনের রায় ফিকাহ শাস্ত্রের বড় বড় গ্রন্থে যুক্তি সহকারে লিপি বদ্ধ করা হয়েছে।
কোরআন, সুন্না, ইজমা, কিয়াস অনুযায়ী মুসলমানদিগকে সুন্নী বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বলা হয়। চার ঈমামের মধ্যে শরিয়তের মৌলিক কোন নির্দেশের ব্যাপারে মত-পার্থক্য নেই। যেমন ঃ-নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, জাকাত ইত্যাদি কাজগুলো যে ফরজ, এ ব্যাপারে সবাই একমত।
শুধু মাত্র খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ে এই চার ঈমামদের মধ্যে মতের পার্থক্য  দেখা দেয়ায় আজ মুসলিম বিশ্ব বিভিন্ন মতবাদ বা মাজহাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

চার ঈমামের মধ্যে মতভেদ ও চারটি মাজহাবের সৃষ্টি এবং চার ঈমামদের নাম

মাজহাব অর্থ মত বা পথ। চার ঈমামের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে মতভেদ হওয়ার কারণে চারটি মাজাহাবের সৃষ্টি হয়েছে। এ সব মতভেদের বহুবিধ কারণও আছে। যেমন:-
১। হাসীদের বর্ণনার বৈষম্য:- রাসুলে করিম (সাঃ)- এর কথা, কাজ ও অনুমোদন প্রাপ্ত বিভিন্ন ঘটনা সাহাবীদের মুখে শ্রবণ করে বহু বর্ণনাকারী তা অপরের নিকট বর্ণনা করেছেন। তাই একই হাদীস বিভিন্ন সূত্র থেকে বর্ণিত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
২। হাদীসের ব্যাখ্যা:- হাদীসের ব্যাখ্যার মধ্যেও নানা রকম মতভেদ দেখা দিতে পারে।
৩। বর্ণনার সূত্রঃ- অনুরূপ ভাবে বর্ণনা সূত্রেও হয়ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ থাকতে পারে। যেমন- এক বিষয়ের একাধিক হাদীসের মধ্যে কোন একটির বর্ণনা অন্য বর্ণনাকারীগণ হতে অধিক নির্ভরযাগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তাই একজন ঈমামের বিবেচনায় যে হাদীসটি দলিল হিসাবে গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি তা অপর ঈমামের কাছে গ্রহনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। আবার বিভিন্ন সূত্র থেকে বর্ণিত একই মর্মের হাদিসের একটি বর্ণনাকে একজন ঈমাম অধিকতর নির্ভরযোগ্য মনে করেছেন অন্য জন করেন নি। যেমন- ফজরের নামাজ অন্ধকারে পড়া ভাল না, ফর্সা হলে পড়া ভাল। এ ব্যাপারে দুই ঈমাম দুই হাদীস গ্রহন করে দুই মত গ্রহন করেছেন। প্রত্যেকেই আবার দলিল দ্বারা তা প্রমাণও করেছেন।
ঈমামের পিছনে মুক্তাদিগণের কেরাত পড়তে হবে না চুপ করে থাকতে হবে এ ব্যাপারে দুই মত বা রায় রয়েছে এবং প্রত্যেকেরই যুক্তির ভিত্তি হাদীস শরীফ। অবশ্য শরীয়তের মৌলিক কোন নির্দেশের ব্যাপারে ঈমামগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। যেমন- কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত ইত্যাদি যে ফরজ এ বিষয়ে সবাই সম্পূর্ণ একমত।
খুঁটি-নাটি বিষয়ে ঈমামগের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হওয়াতেই মুসলিম জাহানে বিভিন্ন মতবাদ বা মাজহাবের সৃষ্টি হয়েছে। যে সকল সমস্যার সমাধান কোরআন ও হাদিসে পাওয়া যায় না, এ ক্ষেত্রে গবেষণা ও কিয়াসের মাধ্যমে বিধান দেয়ার বেলায়ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- আমরা প্রায়ই দেখতে পাই দুইজন দক্ষ আইনজীবি মৌলিক আইনের ব্যাখ্যায় একমত হওয়া সত্ত্বেও এর উপ-বিধি ব্যাখ্যায় ভিন্ন ভিন্ন রায় দিয়ে থাকেন।
এটা দোষনীয় নয় বরং মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “যারা এই জাতীয় গবেষণায় আÍনিয়োগ করবে, তারা নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌছালে দুইটি পুরস্কার লাভ করবে, আর ভুল হলেও শ্রমের মর্যাদা হিসাবে একটি পুরস্কার লাভ করবে।”
মুসলমানদের মধ্যে যারা শরিয়ত ও তরিকতের দিশারী ঈমাম হযরত আবু হানীফা (রঃ)- এর মাযহাব বা মতের অনুসারী তাদেরকে হানাফী বলা হয়। বর্তমান বিশ্বে তাঁর মতাবলম্বীদের সংখ্যাই বেশী। আর ঈমাম মালেক (রঃ)- এর মতাবলম্বীগণকে মালেকী, ঈমাম শাফী (রঃ)- এর অনুসারীদের শাফেঈ এবং ঈমাম আহম্মদ ইবনে হাম্বল (রঃ)- এর মতাবলম্বীগণকে হাম্বলী বলা হয়।
উল্লেখিত চার মাযহাবের ঈমামগণের মিলিত কিয়াস বা রায়ে ব্যক্তিগত চিন্তার ও যুক্তির সাহায্যে অভিমত দেয়া হয়েছে বলে কিছু সংখ্যক ফকীহ ঐ সকল মাজহাবের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেন এবং তারা হাদীসের উপর অধিকতর মত পোষণ করেন। ফলে সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে আহলুল হাদীস নামে আরও একটি পঞ্চম দলের সৃষ্টি হয়েছে। এই দলে ঈমামগনের নাম ইয়াহ ইয়া ইবনে আকছাম ও দাউদ ইবনে আলী ইসপাহানী।

শরীয়তের চারটি দলিল ও মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম পালনের তরিকা নির্ণয়

মুসলমানদের জন্য শরীয়তের চারটি দলিল রয়েছে। এগুলো হলো- ১। কোরআন শরীফ ২। হাদীস শরীফ ৩। এজমা ৪। কিয়াছ (ফিকাহ)।
শরীয়ত ও তরিকতের যত হুকুম-আহকাম আছে তা এই চারটি দলিল দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। মুসলমানদের জীবন পরিচালনার জন্য এই চারটি দলিলই নির্ধারিত। এ ছাড়া আর কোন দলিল নেই।

আহকামে শরীয়তের ৮টি স্তর এবং কোন কাজের কি মর্যাদা

সাধারণ ভাবে ধর্মকর্ম পালনের জন্য আল্লাহর বিধি বিধানগুলোকে ৮টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা ঃ –
১। ফরজ ২। ওয়াজিব ৩। সুন্নত ৪। মোস্তাহাব ৫। হালাল-হারাম ৬। মাকরুহে তাহরীমি ৭। মাকরুহে তানযীহি ৮। মোবাহ বা জায়েয।
১। ফরজ ঃ-
শরীয়তের এমন কতগুলো বিধান আছে যেগুলো পালন করা অবশ্য কর্তব্য। কোরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলিল দ্বারা অবশ্য পালনীয় ও অলঙ্ঘনীয় বলে প্রমাণিত। আর এ ধরণের বিধানকেই ফরজ বলা হয়। ফরজ কাজ কোন অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা যাবে না। অবজ্ঞা সহকারে বর্জন করলে কবীরা গুনাহ্ হবে- কিছুতেই ঈমান থাকবে না এবং অস্বীকার করলে সে কাফির হবে। তবে যে ব্যক্তি ফরজ কাজ না করবে তাকে ফাসিক বলা হয়।
ফরজ দুই প্রকার । যথাঃ- ক) ফরজে আইন খ) ফরজে কিফায়া।
ক) ফরজে আইন ঃ- যেসব ফরজ কাজ স¤পাদন করার জন্য বালেগ বুদ্ধিমান প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তিগত ভাবে দায়ী, তাকেই ফরজে আইন বলে। যেমন- কলেমা পড়া, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, রমজানের রোজা পালন করা, যাকাত আদায় করা, স¤পদশালী সুস্থ ব্যক্তির একবার হজ্জ পালন করা, আবশ্যক পরিমাণে ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা, জুমআর নামাজ আদায় করা, পর্দা পালন করা ইত্যাদি।
খ) ফরজে কিফায়া ঃ- যে কাজ পালন করা মুসলমানদের উপর ফরজ, কিন্তু সমাজের কতিপয় মুসলমান ঐ কাজ স¤পন্ন করলে অবশিষ্ট সবাই তা থেকে মুক্তি পায় তাকেই ফরজে কিফায়া বলে। আর কেউ পালন না করলে সকলেই সমভাবে ফরজ তরক করার অপরাধে গুনাহগার হবে। এই ফরজ আদায়কারীগণ অশেষ ছওয়াব লাভে ধন্য হবে। যেমন- জানাজার নামাজ পড়া, জ্বিহাদ করা, আবশ্যক পরিমাণের চাইতে বেশী এলমে দ্বীন শিক্ষা করা, ইসলাম প্রচার করা, ইসলামী খেলাফত স্থাপন করা, ইসলামী নিয়ম রক্ষার্থে ইমাম বা আমীরুল মোমেনীন নিযুক্ত করা ইত্যাদি।
২। ওয়াজিব:-
ওয়াজিব ফরজের কাছাকাছি এবং অবশ্য পালনীয়। ফরজ তরক করলে যেমন ফাসিক ও গুনাহগার এবং শাস্তির উপযুক্ত হয়, ওয়াজিব তরক করলেও তদ্রুপ গুনাহগার হতে হয় এবং শাস্তির উপযুক্ত হয়। শুধু পার্থক্য এতটুকু যে ফরজ অস্বীকারকারী কাফের হবে, কিন্তু ওয়াজিব অস্বীকার করলে কাফের হবে না, ফাসেক হবে। যেমন- বিতরের নামাজ পড়া, কোরবাণী করা, ফিৎরা দেয়া, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা- এর নামাজ আদায় করা ইত্যাদি।
৩। সুন্নত:-
যে সকল কাজ আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নিজে করেছেন, উম্মতগণকে করার জন্য তাকিদ দিয়েছেন, কিন্তু তা না করলে শাস্তির বিধান নাই সেগুলোকে নবীর সুন্নত বলে। তবে এ কাজগুলো করার জন্য মহানবী এবং সাহবীগণ মুসলমানদের জন্য কর্তব্য রূপে নির্ধারণ করেছেন।
সুন্নত দুই প্রকার। যথা :- ক) সুন্নতে মোয়াক্কাদাহ ও খ) সুন্নতে গায়ের মুয়াক্কাদাহ বা সুন্নতে যায়িদাহ।
ক) সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ:- যে কাজ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) অথবা তাঁর সাহাবাগণ সব সময় করেছেন, অন্যকেও তা করার জন্য তাকিদ দিতেন, শুধু তাই নয় বিনা ওজরে কখনও ছাড়েন নাই তাকেই সুন্নতে মোয়াক্কাদাহ বলে। যেমন- আযান ও ইকামত দেয়া, ফজরের ফরজ নামজের পূর্বে দু’রাকাআত, যোহর নামাজের পূর্বে চার রাকাত ও পরে দু’রাকাত, ত্রশা ও মাগরিবের ফরজের পরে দু’রাকাআত নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। খতনা, বিবাহ ইত্যাদিও এর অন্তর্ভূক্ত।
সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ আমলের দিক থেকে ওয়াজিবের মতই। অর্থাৎ যদি কেউ বিনা ওজরে সুন্নতে মুয়াক্কদাহ ত্যাগ করে অথবা তরক করার অভ্যাস করে তবে সে ফাসিক ও গুনাহগার হবে এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- এর সাফায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এই গুনাহ ওয়াজিব তরকের চাইতে কম হবে। তবে কখনও ওজর বশতঃ ছুটে গেলে তার কাজা আদায় করতে হবে না।
খ) সুন্নতে গায়ের মুয়াক্কাদাহ বা সুন্নতে যায়িদাহঃ- যে সব কাজ মহানবী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবাগণ কখনও করছেন আবার কখনও ওজর ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছেন এমনকি এ ব্যাপারে কাউকে করতে তাকিদ করেননি তাকেই সুন্নতে গায়ের মুওয়াক্কাদাহ্ বলে। এটা পালন করলে সওয়াব আছে, না করলে গুনাহ নাই।
৪। মুস্তাহাব:-
যে কাজ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এবং তাঁর সাহবাগণ মাঝে মাঝে উৎসাহ ভরে করেছেন, কিন্তু হামেশা বা অধিকাংশ সময়ই করেন নাই, তাকেই মুস্তাহাব বলে। এ কাজ না করলে গুনাহ হবে না, কিন্তু করলে নেকী পাওয়া যাবে। মুস্তাহাবকে নফল বা মান্দুর নামে অভিহিত করা হয়। ফরজ, ওয়াজিব এবং সুন্নতের অতিরিক্ত ইবাদত মুস্তাহাব বলে গণ্য।
৫। হালাল:-
হালাল অর্থ বৈধ বা সিদ্ধ। যে সকল বিষয় কোরআন বা হাদীস দ্বারা পরিষ্কার ভাবে বৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে তাকেই হালাল বলা হয়। যে কাজে আল্লাহর অবাধ্যতা পাওয়া যায় না এবং অন্য কারও অধিকার ক্ষুন্ন হয় না তা হালাল বলে বিবেচিত। হালাল- হারামের বিপরীত। হালাল যেমন গ্রহনীয়, হারাম তেমনি বর্জনীয়। যেমন- আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশিত পন্থায় ব্যবসা করা, লেনদেন করা, কোন হালাল প্রাণীর গোশত খাওয়া ইত্যাদি হালাল। হালাল বস্তু অসংখ্য, যা তালিকা ভুক্ত করা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ বলেছেন-

“হে মানবমন্ডলী! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার কর।”
( মুমিন ৫১)

৬। হারাম:-
যে সকল কাজ কোরআন ও সুন্নাহ্র ¯পষ্ট নির্দেশে অবশ্য পরিত্যাজ্য ও বর্জনীয় তাকে হারাম বলে। যদি কেউ হারাম কাজকে হারাম বলে অস্বীকার করে অথবা হারামকে হালাল বলে বা জায়েজ মনে করে তবে সে কাফির হয়ে যাবে। আর যদি ওজরে হারাম কাজ করে কিন্তু হারামকে হারাম বলে অস্বীকার না করে অর্থাৎ হারামকে হালাল মনে না করে, তবে সে কাফের হবে না, ফাসিক হবে। শাস্তির উপযুক্ত হবে।
হারাম বস্তুর সংখ্যা সীমিত। এ কারণে নিুে কতিপয় হারাম বস্তুর তালিকা প্রদান করা হল-
ক) মৃত জীব ভক্ষণ করা হারাম তবে মৃত মাছ খাওয়া হালাল।
খ) যবাই করার পর যে রক্ত প্রবাহিত হয় তা হারাম, তবে হালাল জন্তুর গোশতের মধ্যে যে রক্ত থেকে যায় তা হারাম নয়।
গ) শুকরের গোশত খাওয়া হারাম।
ঘ) মানুষের গোশত খাওয়া হারাম।
ঙ) যে সকল প্রাণী কোন দেব দেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়, তার গোশত হারাম।
চ) হালাল জন্তুর গলা টিপে, কুপিয়ে, উচু থেকে ফেলে দিয়ে অথবা ভোতা অস্ত্র দিয়ে হত্যা করলে তার গোশত খাওয়া হারাম। এতে রক্ত প্রবাহিত হয় না, এটা নিষ্ঠুর আচরণ।
ছ) হিংস্র প্রাণী, যেমন- সিংহ, বাঘ, ভালুক, শিয়াল, কুকুর, ইত্যাদি এবং হিংস্র পাখি যেমন বাজ, চিল ইত্যাদির গোশত হারাম।
জ) যে সকল প্রাণী সাধারণতঃ নাপাক ও মরা জীব জন্তু খেয়ে বাঁচে, তাও হারাম। যেমন- কাক, শকুন ইত্যাদি।
ঝ) যে সব প্রাণী বিষাক্ত ও ক্ষতিকর তাও হারাম। যেমন- সাপ, বিচছু ইত্যাদি।
ঞ) গাধা, খচচর এবং হাতির গোশত খাওয়া হারাম।
ট) যে সকল দ্রব্য মস্তিষ্কে বিকৃত ঘটায় ও উম্মাদনা সৃষ্টি করে তা পান করা হারাম। যেমন- মদ, আফিম ইত্যাদি।
৭। মাকরূহ:-
এই মাকরূহ দুুই ভাগে বিভক্ত। যথা- ক) মাকরূহে তাহরীমি খ) মাকরূহে তানযীহি।
ক) মাকরূহে তাহরীমি:- যদি কেউ বিনা ওজরে মাকরূহে তাহরীমি কাজ করে, তবে সে ফাসিক হবে এবং আযাবের উপযুক্ত হবে।
খ) মাকরূহে তানযীহি:- এটা না করলে সওয়াব আছে, করলে আযাব নাই।
৮। মুবাহ (নফল বা মান্দুব):-
মুবাহ কাজে আল্লাহতায়ালা মানুষ জাতিকে স্বাধীনতা দান করেছেন অর্থাৎ কোন কাজ করা না করার ক্ষমতা মানুষের ইচছার উপর নির্ভরশীল। করলে ছওয়াব আছে না করলে আজাব নাই।
মুবাহ কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মাছ-গোশত খাওয়া, পানাহার করা, কৃষিকাজ করা, ব্যবসা বানিজ্য করা, দেশ ভ্রমণ করা, আল্লাহর সৃষ্টি দর্শন করা ইত্যাদি।
তবে মুবাহ কাজের সঙ্গে যদি ভাল নিয়্যত ও ভাল ফল যুক্ত হয় তবে তা ছওয়াবের কাজ হয়ে যায়। যেমন- যদি কেউ এলেম হাসিল করার জন্য, ইসলামের খেদমত করার জন্য, জি¦হাদ ও তবলিগ করার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীর স্বাস্থবান করে তবে সে সওয়াব পাবে। আর যদি পর-স্ত্রীকে দেখানো বা বাহবা কুড়ানোর জন্য ভ্রমণ, নাজায়েজ কীর্তিকলাপ, খেলাধুলা এবং রং তামাশায় যোগদান করে তবে তা হবে গুনাহের কাজ।

(চলবে———)।

Related posts

Leave a Comment