ইনসানে কামিল

– ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি (৫) রোকন বা খুঁটি (বেনায়ে ইসলাম)

পবিত্র ইসলাম ধর্মকে রাব্বুল আলামীন পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এগুলোকে সাধারণ ভাবে স্তম্ভ বা খুঁটি বলা হয়। এর একটিও যদি কেউ বাদ দেয় তবে সে আর ইসলাম ধর্মে থাকতে পারবে না। স্তম্ভগুলো হলো ঃ- ১। কালেমা ২। নামাজ ৩। রোজা ৪। হজ্জ ও ৫। যাকাত।
আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালানকর্তা বা সর্বময় মালিক বলে বিশ্বাস করে যে ব্যক্তি ঈমান আনবে তাকেই এই পাঁচটি বিষয়ের প্রতি পূর্ণ একীন রাখতে হবে। এটা উম্মতে মোহাম্মদীগনের বৈশিষ্ট্য। ফর্মাবর্দ্দার বান্দার মূল কর্ম ও ধর্ম। যার মধ্যে এই পাঁচটি রোকনের অস্তিত্ব নাই তাঁর ধর্মও নাই।

ঈমান ও ইসলাম কি?

ঈমান অর্থ বিশ্বাস। অন্য কথায় আস্থা স্থাপন করা। অন্তরে গভীর প্রত্যয় অর্জন করা। ইসলাম শব্দটি ছলম ধাতু হতে উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ প্রশান্তি। অন্য অর্থে স্বেচছায় কারও অনুগত হওয়া। অর্র্থাৎ বিনা দ্বিধায় বিনা কথায়, বিনা আপত্তিতে কারও আদেশ, নিষেধ, হুকুম মেনে নেয়া এবং মেনে চলা। এখানে ঈমান বলতে আল্লাহ পাকের নিকট স¤পূর্ণ ভাবে আÍসমর্পন করা। নিজের আসল পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহর রাব্বুবিয়াতে নিজকে বিলিয়ে দেয়া। একমাত্র তার উবদিয়াতে (গোলামীতে বা এবাদতে) মশগুল হওয়া, অত্যন্ত খাঁটি অন্তরে আল্লাহর উলহিয়াতের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতঃ নিজকে তার প্রকৃত গোলামীতে নিয়োজিত রাখা। সজ্ঞানে এই বলে ঘোষণা দেয়া যে-
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই আমি যার এবাদত বা গোলামী করতে পারি) এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।”
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- কে আল্লাহ পাক তাঁর আদর্শের প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা রূপে মানব জাতির নেতা ও পথ প্রদর্শক হিসাবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। এই কালেমাই ইসলামের মূল ভিত্তি বা বুনিয়াদ। কালেমার অন্তর্নিহিত গুণ বা সত্তার অধিকারী হলেন আল্লাহ। আর এই গুণ বা সেফাত সমূহ যার মধ্যে নেই তিনি কখনও রব বা আল্লাহ হতে পারে না। আল্লাহ পাক হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)- কে রাসুল বলে ঘোষণা করে মানুষ জাতিকে জানাতে বা বুঝাতে চেয়েছেন, যে মোহাম্মদ (সাঃ) শুধু একজন মানুষই নয় বরং তিনি আল্লাহর সঠিক পরিচয় দাতা। স্রষ্টার ও গোলামের প্রকৃত স¤পর্ক এবং আল্লাহ পাকের পবিত্র কোরআন ও শরীয়তের আদেশ, নিষেধ, করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় কার্যাদি সঠিক ভাবে মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রেরিত ও নিযুক্ত পথ প্রদর্শক।
ঈমানের মূল বস্তু আল্লাহর তাওহীদে পূর্ণ একীন। একত্ববাদে (তৌহীদে) যার বিশ্বাস হয়নি সে প্রকৃত ঈমানদার নয়। আল্লাহর সঠিক পরিচয় না জানা পর্যন্ত কারও দীলে প্রকৃত ঈমান আসতে পারে না, অন্তরে আল্লাহর ভয় পয়দা হতে পারে না। তাঁর রাবুবিয়াত সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ না করা পর্যন্ত তাঁর উবদিয়াতে মন রুজু হতে পারে না।

অর্থাৎ “রহমতের আশা এবং আযাবের ভয় এই উভয়ের মধ্যেই ঈমান।”

উল্লেখিত দু’টির মধ্যে যে কোন একটি না থাকলে ঈমান নেই। ঈমানই নেক আমলের উৎস। আর এবাদতের অšতর হলো আল্লাহর মারেফাত বা পরিচয়। ঈমান ব্যতীত আল্লাহর দরবারে বান্দার কোন কাজই নেক আমল বলে গৃহীত হবে না।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। হযরত নুহ নবী (আঃ) হতে ইসলাম ধর্মের আইন কানুন প্রবর্তীত হয়। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)- এর সময় ইসলাম ধর্মের অনেক প্রসারতা লাভ করে।
আমাদের প্রিয় নবী, উম্মতের কান্ডারী রাহমাতুল্লিল আলামীনের উপর আল্লাহর খাছ মেহেরবাণী ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিধান নামা পবিত্র কোরআন নাজিল হয়। অর্থাৎ আল্লাহর শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী সাইয়েদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন, সাকিয়ে কাউসার শাফিউল মুজনেবীন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামই হলেন পূর্ণাঙ্গ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। আল্লাহ পাক ফরমায়েছেন-

“অর্থাৎ নর-নারী যে-ই হোক , ঈমানদার অবস্থায় যে সৎকাজ করবে সেই বেহেশতে প্রবেশ করবে।”
(সুরা মুমিন, পারা ২৪,আয়াত৪০)

অন্যত্র আল্লাহ পাক বলেছেন-

“ঈমান ব্যতীত নেক আমল করা বৃথা।”

আর সৎ কাজের প্রতিফল স্বরূপ কেউ দুনিয়াতে কিছু পেতেও পারে আবার নাও পেতে পারে। কিন্তু ঈমান বিহীন ভাবে মারা গেলে আখেরাতে তার নিস্তার নেই। ঈমান ঠিক রেখে আল্লাহ পাকের নির্দেশ পালন করে দুনিয়া হতে বিদায় নিতে পারলে পরকালে আল্লাহ পাকের তৈরী অনিন্দ্যসুন্দর ও পরম সুখের স্থান বেহেশত লাভ করা যাবে। আল্লাহর হাবীব বলেছেন-
“কোন কাফের বেঈমান ব্যক্তি যেমন বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না, ঠিক তেমনি কোন খাঁটি ঈমানদার মুসলমান ব্যক্তিও দোজখে প্রবেশ করবে না।”
“ঈমান ও একীন” শব্দ দু’টির ইসলামী শরিয়তের ভাষায় তার অর্থ হচেছ মুখে স্বীকার করা সহ আল্লাহর ও তাঁর সকল গুণাবলীতে আন্তরিক ভাবে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা এবং হযরত নবী করিম (সাঃ) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে তাঁর বান্দাগণের নিকট যা যা পৌঁছে দিয়েছেন সেগুলোকে সত্য বলে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা।

ঈমানের বিষয়ে হাদীসে জিব্রাঈল

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে (এটি একটি দীর্ঘ হাদীস)- একজন আগšতক (জিব্রাঈল আঃ) হযরত রাসুলে খোদা (সাঃ) কে বললেন- বলুন, ঈমান কি জিনিস? আল্লাহর রাসুল বললেন- আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশেতা, তাঁর কেতাব, তাঁর রাসুল, আখেরাত, তকদীরের ভাল মন্দ, যা কিছু হয়েছে বা হচেছ সব কিছুই আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে হচেছ, তা জানা এবং মানার নামই ঈমান। (মুসলিম শরীফ)

ঈমানের অর্থ হলো কারও উপর নির্ভর করা এবং নির্ভরতার কারণে তার কথাবার্তাকে সত্য বলে অন্তরে বিশ্বাস করা এবং মুখে স্বীকার করা। যে কেউ যখন কাউকে বিশ্বাস করে তখন সে তার যাবতীয় আদেশ নিষেধ সহ সব কিছু মাথা পেতে গ্রহন করে। এই আস্থা ও বিশ্বাসের নামই ঈমান। আর ঈমানই হচেছ ইসলামের প্রাণ শক্তি।
রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে রাসুলে পাকের মাধ্যমে যে সমস্ত কথা বা হুকুম এসেছে তার সবগুলিকে সত্য বলে স্বীকার করে আন্তরিক ভাবে গ্রহন করা এবং নিয়মিত ভাবে তা পালন করাই হল মোমেন হওয়ার জন্য জরুরী। ঈমানের সংরক্ষিত বিবরণী (স্বীকৃতি) সম্বন্ধে নিুে আরো বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হলো : –

১। ঈমানে মোজমাল (সাধারণ বিশ্বাস)

আমানতু বিল্লাহে কামা হুয়া বিয়াস মা ইহি ওয়াসিফাতিহি ওয়াকাবিলতু জামিয়াহ আহকামিহি ওয়া আর কানিহি।

অর্থ- “আমি আল্লাহর প্রতি ও তার যাবতীয় নাম ও গুনাবলীতে যথাযথ ভাবে ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং যাবতীয় আদেশ নিষেধ ও বিধান সমূহ (সর্বান্তঃকরণে) মেনে নিলাম।”

২। ঈমানে মোফাচছাল (ব্যাপক বিশ্বাস)

ঈমানের মূল বিষয়বস্তু হলো মোট ৭টি । ঈমানে মোফাচছালের মধ্যে এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। যথা-

আমানতু বিল্লাহে ওয়া মালাইকাতিহি, ওয়াকুতুবিহি, ওয়া রুসুলিহি, অল ইয়াওমিল আখিরি, অল ক্বাদরিহি, খাইরিহি, ওয়া শাররিহি মিনালল্লাহি তায়ালা, ওয়ালবাছে বায়াদাল মাউত।
আমি ঈমান আনলাম ১) আল্লাহর প্রতি ২) তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি ৩) আল্লাহ পাকের নাজেল কৃত কেতাব সমূহের প্রতি ৪) তাঁর প্রেরীত রাসুলগণের প্রতি ৫) কিয়ামত ও আখেরাতের প্রতি ৬)পুনর্জীবন লাভের প্রতি ৭) তকদীর বা অদৃষ্টের প্রতি।

উল্লেখিত এই ৭টি বিষয়ই ঈমানের প্রধান অঙ্গ। ঈমানের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই ঘোষণা দেয়া এবং সর্ব নিুতমটি হলো পথ থেকে কষ্ট দায়ক কাঁটা বা বস্তু অপসারণ করা এবং লজ্জাবোধ করা।

(চলবে——–)

Related posts

Leave a Comment