শেষ মুহূর্তে ভোটারদের কাছে ছুটছেন প্রার্থীরা

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

আর এক দিন পর আগামী সোমবার বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হতে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রকাশ্য প্রচার শেষ হচ্ছে আজ শনিবার মধ্যরাতে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালার ৭৪ বিধি অনুসারে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার ৩২ ঘণ্টা আগে নির্বাচনী এলাকায় কেউ জনসভা করতে পারবেন না। কোনো মিছিল বা শোভাযাত্রাও করা যাবে না।
এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে এ দুই সিটিতে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার ছিল জমজমাট। আবহাওয়াও ছিল অনুকূল। গতকালের বৃষ্টি তাপপ্রবাহ কমিয়ে আনায় স্বস্তি ছিল সবার মধ্যে। তবে অনেকের নির্বাচনী পোস্টার বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়।
মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মুসল্লিদের কাছে ভোট প্রার্থনা ছাড়াও ভোটারদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছানোর চেষ্টা ছিল প্রায় সব প্রার্থীর। কার সঙ্গে দেখা করা বাকি থাকল, কোন পাড়া-মহল্লায় কম নির্বাচনযাওয়া হয়েছে—এসবের হিসাব মিলিয়ে পরিকল্পিত প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা।বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন ভোটার নম্বর।
বরিশালের ভোটার উপস্থিতি নিয়ে তেমন উদ্বেগ না থাকলেও খুলনায় এ বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
সে কারণে এই সিটিতে নির্বাচনী প্রচারে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির বিষয়টিকে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া আজ মধ্যরাত থেকে নির্বাচনী এলাকায় নিষিদ্ধ হচ্ছে মোটরসাইকেল চলাচল। আগামীকাল রবিবার মধ্যরাত থেকে ট্রাক, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, জিপ, কার, ইজি বাইক চলাচলও বন্ধ হবে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা প্রার্থী, প্রার্থীর এজেন্ট, সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জন্য শিথিল থাকবে। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
এদিকে নির্বাচন কমিশনও ভোটের সব রকম প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের কাজ চলছে। দুই সিটিতেই পৌঁছে গেছে ইভিএম।

বরিশালে মসজিদে মসজিদে প্রচার : গতকাল বরিশালের মেয়র প্রার্থীদের অন্যতম প্রচারের স্থান ছিল মসজিদগুলো। নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত গতকাল শহরের চৌমাথার মারকাজ মসজিদে প্রচার চালান। তিনি দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে ওই মসজিদে উপস্থিত হন। ১২টা ৫০ মিনিটে তিনি সেখানে মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিছিয়ে পড়া বরিশালকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আপনারা সহযোগিতা করলে আমি বরিশালকে উন্নত বরিশাল হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।’ পরে চৌমাথা বাজারে তিনি গণসংযোগ করেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও বরিশাল সিটিতে মেয়র পদপ্রার্থী গতকাল এবাদুল্লাহ মসজিদে জুমার নামাজের আগে ভোট প্রার্থনা করেন মুসল্লিদের কাছে। তিনি বলেন, বরিশালের মানুষের এখন সংকটময় মুহূর্ত। জানমালের নিরাপত্তা নেই, চাকরিতে নিরাপত্তা নেই, সড়কে নিরাপত্তা নেই, নারীদের নিরাপত্তা নেই, চিকিৎসাসেবায় নিরাপত্তা নেই—সর্বত্রই নিরাপত্তাহীনতায় নগরবাসী। সব কিছুতেই ঘুষ দিতে হচ্ছে। তাই এই সব কিছু থেকে বের হয়ে আসতে ইসলামের শাসন দরকার।
তিনি সেখানে জুমার নামাজের ইমামতি করেন। পরে তিনি নগরীর চকবাজার, বাজার রোড, ফলপট্টি এলাকায় গণসংযোগ করেন।
তাঁর অনুসারীরা শহরের দুই শতাধিক মসজিদে একযোগে প্রচার চালান। অন্য প্রার্থীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না।
বিএনপির প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ মুসলিম গোরস্থান মসজিদে প্রচার চালান। তিনি মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার বাবা প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামাল আপনাদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর জীবন যৌবন সব কিছুই বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের সেবায়। তাঁর সন্তান হয়ে আমি আপনাদের সেবা করতে চাই।’
এর আগে রূপণ কীর্তনখোলার তীরের কেডিসি বস্তি এলাকায় গণসংযোগ করেন।
জুমার নামাজের আগে চৌমাথা এলাকায় শোভাযাত্রা করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস। নবগ্রাম থেকে শুরু এই শোভাযাত্রা শহরের বেশ কয়েকটি সড়ক প্রদক্ষিণ করে। হুড খোলা গাড়িতে চড়ে সাধারণ মানুষের কাছে করজোরে ভোট প্রার্থনা করেন তাপস। গাড়ির পেছনে বেশ কয়েকটি পিকআপ ভ্যানে ছিলেন দলের কর্মীরা। তাপস জানান, সকালের বৃষ্টিতে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রচার বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
১৪ দলের নেতাদের মাঠে নামানোর উদ্যোগ : বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, হাতপাখার প্রার্থীকে কে টাকা দিয়েছে বা দেয়নি, সেটা আলোচ্য নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতকে এই নির্বাচনে জয়ী করতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাতের ওই মতবিনিময়সভায় নানক আরো বলেন, ‘আমরা বরিশালের ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি মানুষের দুয়ারে খোকন সেরনিয়াবাতের জন্য ভোট চাইব।’
সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমরা আসলে আপনাদের কষ্ট দিতে চাইনি বলেই প্রথম দিকে আপনাদের ডাকিনি। কিন্তু এই শেষের দুই দিন আমরা আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা আশা করছি।’
খুলনায় ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে প্রচার : খুলনায় নাগরিক নেতাদের ধারণা, এবারের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনটি অনেকখানি আকর্ষণ হারিয়েছে। কেসিসির গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এবারে মেয়র পদে বিএনপি প্রার্থী নেই। নির্বাচনী মাঠে শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক।
তার পরও খালেক সকাল থেকে রাত অবধি নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে আসছেন। প্রতিদিন নগরের একাধিক জায়গায় গণসংযোগ, মতবিনিময়সভা করছেন। ভোটারদের হাতে নিজের লিফলেট বিতরণ করছেন।
গতকাল তালুকদার আব্দুল খালেক সকাল ৮টার দিকে রায়েরমহল, সকাল ১০টার দিকে শেখপাড়া বাজার এলাকায় লিফলেট বিতরণ ও ব্যাপকভাবে গণসংযোগ করেন। বিকেল ৫টায় চানমারী বাজারে গণসংযোগ এবং সন্ধ্যায় ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘খুলনাবাসীর প্রত্যাশা পূরণে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও চেষ্টা করে যাব। খুলনা সিটিকে ঢেলে সাজাতে নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এবারেও নগরবাসীর রায় চাই।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী মাওলানা আব্দুল আউয়াল গতকাল সারা দিন খালিশপুরের নয়াবাটি, ক্রিসেন্ট মিল এলাকা, আলমনগর হাউজিং এলাকায় গণসংযোগ করেন। এ সময় তিনি ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হচ্ছে। এ পর্যন্ত যত রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়েছে, তারা কেউই দেশবাসীকে শান্তি দিতে পারেনি। গত ১৪ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের টাকাও লুটপাট হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির লাঙল প্রতীকের প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম মধু নগরীর ডাকবাংলো মোড়, বড় বাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন। তিনি এ সময় বলেন, ‘আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করলে আমি কেসিসি এলাকা সম্প্রসারণ করব। নগরীর ২২ খাল উদ্ধার করে নগরীকে একটি বিনোদননগরী হিসেবে গড়ে তুলব। বেকারত্ব দূরীকরণে কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব, গুণীজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেব।’
বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ, খুলনা মহানগর ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে তালুকদার আব্দুল খালেকের পক্ষে গতকাল প্রচারণা চালানো হয়।
কাউন্সিলর প্রার্থীরাও ওয়ার্ডের প্রায় সব ভোটারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করার চেষ্টা করেছেন। শেষ মুহূর্তে হিসাব করছেন, কার সঙ্গে দেখা করা এখনো বাকি রয়েছে। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভোটার নম্বর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ভোটের দিন ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী, বর্তমান কাউন্সিলর আলি আকবর টিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আশা করছি, আমার ওয়ার্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসবেন। ভোটাররা আমাকে ভালোবাসেন, এর আগেও তাঁরা আমাকে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত করেছেন। ফলে এবারেও তাঁরা আমাকে এবং আমার দলের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেককে ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যথাসময়ে হাজির হবেন।’
আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান কাজী আমিনুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ভোটার উপস্থিতির বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আমাদের দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরা ছাড়াও সাধারণ নাগরিকরা ভোট দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটকেন্দ্রে হাজির হবেন বলে আশা করছি।’
নাগরিক সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘মেয়র পদে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোটের আকর্ষণ কম; তবু শুরুর দিকে যেমন মনে হয়েছিল, অবস্থা তার চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে। প্রার্থীরাও ছুটছেন। কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটারদের উপস্থিত করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে।’

Related posts

Leave a Comment