শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
দেশে দেশে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় রোধে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্মার্ট আইডি কার্ডের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) নিবন্ধনের আওতায় এনে ভুয়া রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনসহ বিভিন্ন বিষয় রহিত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে সরকারের একটি সূত্রে জানা গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে।
পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এই নিবন্ধন কার্যক্রমের সাথে ইতোপূর্বে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রমকে সমন্বয় করার। এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থান করা বৈধ শ্রমিক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশার লোকের সংখ্যা নির্ণয় করা যাবে। প্রবাসীদের কল্যাণে সরকারের হাতে নেয়া বিভিন্ন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
এছাড়া মাইগ্রেশন সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচিও এই কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করার সুযোগ থাকছে। দিন দিন বিদেশে বাংলাদেশিদের মধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই সংখ্যা বেশি। বিরোধী রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে গ্রেফতার, নির্যাতন, মামলাসহ নানা কারণ দেখিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করছেন।
শরণার্থী, হিউম্যানিটারিয়ান ও সাবসিডিয়ারি- এই তিন ক্যাটাগরিতে আশ্রয় দেয়া হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইউর দেশগুলোতে ফার্স্ট এন্ট্রির ফিঙ্গার কার্যকর হলে আবেদনকারীদের আবেদন যাচাইয়ে সুবিধা হবে। ফলে ভুয়া তথ্য দেয়ার হার অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ করে ইউরোপের সাথে সহায়তার সম্পর্ক থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দিকে এগুতে চাচ্ছে সরকার। এ জন্য এসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে জোর দেয়া হচ্ছে।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপের সাথে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের বিষয়টিও জোর দেয়া হচ্ছে। কারণ এই সুবিধা অপব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট হয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস, মিশনগুলোকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কাজও শুরু করা হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইউ) প্রত্যেক দেশে ফার্স্ট এন্ট্রির ফিঙ্গার কার্যকর হবে। বাংলাদেশ পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সহায়তায় তৈরি হবে একটি প্রবাসী ডাটাবেস। এই ডাটাবেসের সহযোগিতায় লোকাল পুলিশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ডিপোর্ট করবেন। ফলে তথ্য গোপন রেখে কিংবা ভুয়া পরিচয় দিয়ে ইউর কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য করা আবেদন অনুমোদন হবে না।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভাস্থ ইউন মাইগ্রেশনের চিফ অব মিশন ইন বাংলাদেশ জর্জ জিগায়ারি জানান, ইইউভুক্ত দেশগুলোর সাথে অন্যান্য দেশে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার জন্য ডকুমেন্টারি কাজের প্রক্রিয়া এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হবে। এর ফলে কোনো দেশে গিয়ে আর অবৈধ থাকা এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের অপব্যবহারের সুযোগ থাকলো না।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব বলছে, কেবল ইউরোপে নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও আশ্রয় চেয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশগুলোতে সংখ্যা বাড়ছেই। এরকম ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে বৈধ অভিবাসীদের মধ্যেও। সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ প্রবেশ করেছেন, সেই তালিকার শীর্ষ দশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ অপব্যবহারের সাথে দেশের ভাবমূর্তির বিষয়ও জড়িত। এ ধরনের প্রবণতা বাংলাদেশিদের বৈধ অভিবাসনও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নাগরিকত্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হলে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। অবৈধ অভিবাসন আমরা কখনোই উৎসাহিত করিনি, করবোও না। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমরা কাজ করছি।
এদিকে ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বিষয়ক সংস্থা ‘ইউরোস্ট্যাট’র গত ১০ বছরের হিসাব বলছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের আবেদন বেড়েছে, পাশাপাশি আবেদন সফল হওয়ার হারও বাড়তির দিকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সফলতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, আবেদন পড়েছিল ১১ হাজার ২৫০টি। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়েছে ১ হাজার ৭৮৫টিতে। পরের বছর ২০১৬ সালে বাংলাদেশিরা ১৪ হাজার ৮৫টি আবেদন করেন। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়া হয় ২ হাজার ৩৬৫টিতে। সফলতার হার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
২০১৭ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের পক্ষ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ১৬ হাজার ৯৫টি আশ্রয়ের আবেদন পড়ে। এ সময়ে বাংলাদেশিদের করা ২ হাজার ৮৩৫টি আবেদন সফল হয়। শতকরা হিসাবে সফল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছর আবেদন পড়ে ১৯ হাজার ৫২৬টি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাইরে অন্যান্য দেশ মিলিয়ে এই সংখ্যা ২৮ হাজার ৪৮৮। এসব আবেদন সফলতার হার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে যে জরিপ করে, তাতে দেখা গেছে আরো ভালো জীবনযাপন এবং পেশার উন্নতির জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এসব তরুণ নিজের দেশে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।