শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
বাংলাদেশে গত এগারো মাসে গড়ে প্রতিদিন একজন ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
এ মানবাধিকার সংগঠনটির হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯ মালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন। এদের মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে বা তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায়। এর বাইরে ৯৭ জন র্যাবের হাতে, ৩১ জন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাতে ,এবং ৫৩ জন বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতা, মাদ্রাসাশিক্ষক, সাবেক সেনাসদস্যসহ এ বছর গুম হয়েছেন ১৩ জন। গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন চারজন, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে একজনকে। বাকি আটজন কোথায়, কেমন আছেন কেউ জানেন না। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সবশেষ ব্যক্তি সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। গুম হওয়ার ৪৬৭ দিন পর তিনি এ বছরের ১৬ মার্চ ফিরে আসেন। মারুফ জামান বা তাঁর আগে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁরা কেউ আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি।
আসকসহ দেশি–বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত এক দশকে দেশে গুমের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। মা, স্ত্রী, সন্তানসহ স্বজনেরা প্রিয়জনকে ফিরে পেতে প্রতিবছর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন; মানব বন্ধন করেন, সমাবেশ করেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরে পেতে কাকুতি–মিনতি করেন। কিন্তু স্বজনেরা আর ফিরে আসে না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগর অধ্যাপক মিজানুর রহমান
আইন ও শালিশ কেন্দ্রের হিসেব মতে, ২০১৯ সিলে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যাও অনেক। নারী নির্যাতনকারী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নামও জড়িত হয়েছে। এ ছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, মতপ্রকাশে বাধার অভিযোগ ছিল বছরজুড়ে, অব্যাহত ছিল সীমান্ত হত্যা। সভাসমাবেশে পুলিশী বাধার ঘটনা রাজধানী সহ সারা দেশেই ঘটেছে বছরজুড়ে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় নাগরিক হিসেবে নিজেদের লজ্জার কথা তুলে ধরে বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী ফরিদা আখতার রেডিও তেহরানকে বলেন, ২০১৯ সালটি শুরুই হয়েছে একটি বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে। জনগণ অবাক হয়ে দেখল কীভাবে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর, ন্যায্য দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর এমনকী সভা-সমাবেশ করা বা ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে নাগরিকদের ওপরও নির্যাতন নিপীড়ন যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে বিশ্ববাসীর কাছে আমরা লজ্জাজনক অবস্থানে পৌঁছে গেছি।
মানবাধিকার নেত্রী ফরিদা আখতার
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগর অধ্যাপক মিজানুর রহমান স্বীকার করেছেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা কেউ প্রকাশ করলেই তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে সত্য, কিন্তু মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একজন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন, এটা খুব উদ্বেগের কথা। কিন্তু এই উদ্বেগ কি যথাস্থানে পৌঁছাচ্ছে?
কুড়ি বছর আগে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল।কিন্তু বাংলাদেশ কখনো কোনো অধিবেশনে উপস্থিত হয়নি, প্রতিবেদন তো দূরের কথা। এ বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে সরকারি প্রতিনিধিদল জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির সভায় হাজির হয়ে দেশের মানবাধিকার রক্ষায় সংবিধান কীভাবে সুরক্ষা দিয়েছে এবং কী কী আইন করেছে, সে সম্পর্কে জানিয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক
মানবাধিকার প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গনমাধ্যমকে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে আমাদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে, মানবাধিকার বিষয়টি আমরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যাঁরা করছেন, তাঁরা দেশবিরোধী প্রচার চালাতে চান।’
তিনি দাবি করেন, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হয়, তখন কিছু এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। গুম করে কাউকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয় না। দু-একটি ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, এতে যাদের যুক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
-পার্সটুডে