শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ঈদের আগে-পরে ৬ দিনসহ মোট ৭ দিন এক জেলা থেকে আরেক জেলা ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল। তাতে ঈদযাত্রায় ঢাকা ছাড়ার সময় এবং মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধের ওই সময়টায় সড়কে দুর্ঘটনা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। কিন্তু ঈদ শেষে ফেরার পথে সড়ক হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২০ ঘণ্টায় অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় স্বামী-সন্তানসহ অন্তঃসত্ত্বা নারী, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ট্রাকের পেছনে বাসের ধাক্কায় ৪ জন ও বাসচাপায় ছেলেমেয়েসহ মা, বগুড়ার কাহালুতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পথে ৪ জন, পাবনায় পিকআপচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাইক্রোবাস-অটো সংঘর্ষে ২ জন, দিনাজপুরের খানসামায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ভুল লেনে গিয়ে দুই ট্রাকের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হয়েছেন।
ট্রাকচাপায় স্বামী-সন্তানসহ অন্তঃসত্ত্বা নারী নিহত
ময়মনসিংহের ত্রিশালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোর্ট ভবন এলাকায় ট্রাকচাপায় একই পরিবারের তিনজন নিহত ও এক নবজাতক আহত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুর ২টায় উপজেলার মঠবাড়ি ইউনিয়নের রায়মনি গ্রাম থেকে জাহাঙ্গীর আলম (৩৫) তার আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও আড়াই বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য ত্রিশাল পৌর এলাকায় আসেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় দ্রুতগামী মালবাহী ময়মনসিংহগামী ট্রাকটি চাপা দেয় তাদের। এতে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের জাহাঙ্গীর আলম (৩৫), তার স্ত্রী রত্না বেগম (২৬) ও তার মেয়ে জান্নাত (আড়াই বছর) নিহত হয়। অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগমের পেটে থাকা নবজাতক শিশু চাপ খেয়ে রাস্তায় প্রসব হয়। নবজাতক মেয়ে বাচ্চাটিকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক নবজাতক বাচ্চাটিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন।
ত্রিশাল থানার ওসি মাইন উদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পারাপারের সময় দ্রুতগামী মালবাহী ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক একই পরিবারের তিনজনকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করে মমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ট্রাকের পেছনে বাসের ধাক্কা, নিহত ৪
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ট্রাকের পেছনে বাসের ধাক্কায় চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৯ জন। শনিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়নের দুল্যা মনসুর এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
মির্জাপুরের গোড়াই হাইওয়ে থানার ওসি মোল্লা টুটুল ব্ষিয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওসি বলেন, বালুবোঝাই একটি ট্রাকের পেছনে ধনবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা বিনিময় পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বাস ধাক্কা দেয়। এতে বাসের তিন যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান।
পরে আহতাবস্থায় ১০ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয় লোকজন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার করে কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি ওসি।
চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পথে প্রাণ গেল ৪ জনের
বগুড়ার কাহালুতে প্রাইভেটকার ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও একজন আহত হয়েছেন।
শনিবার সকালে উপজেলার দরগাহাট কালিয়াপুকুর এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হতাহতরা এক স্বজনের চিকিৎসার জন্য বগুড়া আসছিলেন।
কাহালু থানার ওসি আমবার হোসেন ও ছিলিমপুর মেডিকেল ফাঁড়ির এমসআই লালন হোসেন এসব তথ্য দিয়েছেন।
নিহতরা হলেন- নওগাঁর ধামুইরহাটের জগৎনগর এলাকার মফিজ উদ্দিনের ছেলে আবদুর রহমান (৩৫) ও গুরুতর আহত শাকিল (২০) একই এলাকার মিরাজুল ইসলামের ছেলে। বাকিদের পরিচয় জানা যায়নি।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নওগাঁর ধামুইরহাট থেকে একটি প্রাইভেটকার বগুড়ার দিকে আসছিল। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কারটি বগুড়ার কাহালু উপজেলার দরগাহাট কালিয়াপুকুর এলাকায় পৌঁছে। এ সময় নওগাঁগামী দ্রুতগতির একটি পিকআপের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থেকে কারটিকে ধাক্কা দেয়।
এতে কারটি দুমড়েমুচড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত ও দুজন গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত আবদুর রহমান ও শাকিলকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন আবদুর রহমান মারা যান।
বগুড়ার ছিলিমপুর মেডিকেল ফাঁড়ির এসআই লালন হোসেন যুগান্তরকে জানান, এক স্বজনের চিকিৎসার জন্য নওগাঁর ধামুইরহাট থেকে প্রাইভেটকারে হতাহতরা বগুড়ায় আসছিলেন। চিকিৎসাধীন শাকিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বাসচাপায় ছেলেমেয়েসহ মায়ের মৃত্যু
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লা এলাকায় রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় ছেলেমেয়েসহ তাদের মা নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন স্থানীয়রা।
এতে মহাসড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে ঈদে কর্মস্থলে ফেরা মানুষেরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
শনিবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক পার হওয়ার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল এলাকার মাসুদের স্ত্রী পারভিন আক্তার (২৮) ও তার ছেলে সুমন (৮) ও মেয়ে সাদিয়া (৬)।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, রাস্তা পারাপারের সময় একটি বাস পারভিন ও তার দুই সন্তানকে চাপা দেয়। দুপুর ১২টায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় স্থানীয়রা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় ঈদে কর্মস্থলে ফেরা মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
টাঙ্গাইলের সহকারী পুলিশ সুপার (মির্জাপুর সার্কেল) মনসুর মুসা বলেন, মহাসড়ক অবরোধকারীদের শান্ত করার চেষ্টা চলছে।
মির্জাপুর থানার ওসি মাসুদ করিম ও গোড়াই হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মোল্লা টুটুল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বাসটি আটক করা সম্ভব হয়নি। মরদেহ আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
ভুল লেনে গিয়ে দুই ট্রাকের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষ, নিহত ৩
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় ভুল লেনে গিয়ে দাঁড়ানো ট্রাকসহ দুটি ট্রাকের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। আহতদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
শনিবার দুপুরে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে উপজেলার খালকুলা বাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি লুৎফর রহমান।
তিনি জানান, আরপি পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ঢাকা যাচ্ছিল। বাসটি ভুল লেনে গিয়ে একটি দাঁড়ানো ট্রাকসহ আরেকটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
মাইক্রোবাস-অটো সংঘর্ষে নিহত ২
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাইক্রোবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন। শনিবার দুপুরে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের উজানিসার এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- অটোচালক চাঁন মিয়া (৫০) ও জেলার কসবা উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের আব্দু মিয়ার ছেলে বিল্লাল মিয়া (৪৫)।
খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসি সুখেন্দ্র বসু দুর্ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, একটি মাইক্রোবাস কুমিল্লার দিকে যাচ্ছিল। পথে উজানিসার এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চালকসহ অটোরিকশার সব যাত্রী আহত হন।
তাদের উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চালক চাঁন মিয়া ও যাত্রী বিল্লাল হোসেন মারা যান। আহত অন্য চারজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেল মোটরসাইকেল আরোহীর
দিনাজপুরের খানসামায় ট্রাকের ধাক্কায় জাকির হোসেন (২৬) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছে। শনিবার দুপুর ১টার দিকে খানসামা ব্র্যাক শাখা অফিসের সামনের পাকা সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত জাকির হোসেন খানসামা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের তফসের আলীর ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ফায়ার সার্ভিস ও থানা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোটরসাইকেলচালক জাকির হোসেন খানসামা বাজার থেকে আমতলী যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়। স্থানীয়রা প্রথমে তাকে খানসামা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়ার পর অবস্থার অবনতি হলে খানসামা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সদস্যরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে খানসামা থানার ওসি খানসামা চিত্তরঞ্জন রায় বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সকলকেই সচেতনতা থাকতে হবে। এতে ক্ষতির হার কমবে।
পিকআপচাপায় মোটরসাইকেলের ৩ আরোহী নিহত
পাবনায় পিকআপচাপায় মোটরসাইকেলের তিন আরোহী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যা বিকাল ৬টার দিকে পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের ছোট পাথাইলহাট নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন- পাবনা সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামের রোস্তম আলীর ছেলে জুয়েল (৩০), রবি চানের ছেলে সুরুজ্জামান (৩৯) এবং জুরান মোল্লার ছেলে মতিন (৬০)। নিহত আব্দুল মতিন নিহত জুয়েল ও সুরুজ্জামানের আপন চাচা।
পুলিশ জানায়, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে একই পরিবারের ওই তিনজন একটি মোটরসাইকেলে করে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর যাচ্ছিলেন। তারা পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের ছোট পাথাইল হাট নামক স্থানে পৌঁছলে একটি অটোভ্যানের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে যায়।
একই সময়ে বিপরীত দিকে থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যান এসে তাদের চাপা দিলে আব্দুল মতিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। স্থানীয়রা জুয়েল ও সুরুজ্জামানকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই দুজন মারা যান।
সাঁথিয়া থানার ওসি (তদন্ত) কমল কুমার দেবনাথ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ঘাতক পিকআপ ভ্যানটিকে আটক করা গেলেও পিকআপভ্যানের চালক পালিয়ে গেছে।-যুগান্তর