হল থেকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে ইডেনের ভুক্তভোগী দুই ছাত্রীকে

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

রাজধানীর ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও ভাইরাল হওয়ার পর একে কেন্দ্র করে তিনি দুই ছাত্রীকে নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এ ব্যাপারে কলেজ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা। বুধবার (২৪ আগস্ট) দিনগত রাতে ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে এ মন্তব্য করেন তিনি। ভুক্তভোগী দুই ছাত্রী রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের বাসিন্দা।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই ভুক্তভোগী ছাত্রীর এক সহপাঠী বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার হওয়া দুই ছাত্রীকে মঙ্গলবার রাতেই হল থেকে স্থানীয় অভিভাবকের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সময় হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা ম্যাম আর কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া (সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য) ম্যাম তাদের হল গেট পর্যন্ত দিয়ে আসেন। অথচ অভিযুক্ত তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ভুক্তভোগীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’
বিষয়টি জানতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইডেন কলেজে আমাদের অনেক ছাত্রী মাঝেমধ্যে হল থেকে বের হয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যায়। তখন তো তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয় না। ওই দুই ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। হল ছেড়ে যে কেউ আত্মীয়ের বাসায় যেতে পারে। এক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে।’
গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না ইয়াসমিন রিভার অডিও ভাইরালের বিষয়টি জানেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইডেন কলেজ সংশ্লিষ্ট কোনো অডিও বা ভিডিও আমার নজরে আসেনি। এরকম কিছু হলে আমি জানতাম। এখন অনেক কিছুই ঘটে। হয়তো অন্যকোনো ঘটনার অডিও বা ভিডিওকে ইডেনের বলে চালানো হচ্ছে।’

‘ইডেন কলেজে আমাদের অনেক ছাত্রী মাঝেমধ্যে হল থেকে বের হয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যায়। তখন তো তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয় না। ওই দুই ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। হল ছেড়ে যে কেউ আত্মীয়ের বাসায় যেতে পারে।’
—নারগিস রুমা, প্রাধ্যক্ষ

তবে ছাত্রলীগ নেত্রীর হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া দুই শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন নারগিস রুমা—এমন একটি ভিডিও ইত্তেফাকের হাতে এসেছে। ভিডিওটি মঙ্গলবার রাতের।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্রলীগ নেত্রী রিভার নির্যাতন ও হুমকির শিকার দুই শিক্ষার্থী হল প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমার দাঁড়িয়ে আছেন। নারগিস রুমা তার চেয়ারে বসে আছেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাও। আমি বলছি, তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাবে।’
এরপর বিভিন্ন কথার পর প্রাধ্যক্ষকে আবার বলতে শোনা যায়, ‘শোনো (ভুক্তভোগীদের একজন), তুমি যেতে চাচ্ছো না, কিন্তু এখন তোমরা দুই গ্রুপের মধ্যে পড়ে গেছো। কোনো একটা গ্রুপ তোমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই দায় কে নেবে?’
এরপর ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বলেন, ‘তাহলে ম্যাম এখন আমাদের কী করা উচিত?’ তখন প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘তোমরা এখনই বাড়ি চলে যাও।’
এ সময় পাশ থেকে আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘রাতে রাখা যায় কি না…।’ তখন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রীকে বলতে শোনা যায়, ‘ম্যাম, রাতে রাখার দরকার নেই।’ আরেকজন বলেন, ‘ম্যাম, রাতে রাখা যাবে না।’
এরপর নারগিস রুমা বলেন, ‘না, রাতে রাখা যাবে না। তুমি বোঝো! রাতে কোনো ঘটনা ঘটলে এই দায় কে নেবে?’

‘অভিযুক্ত তামান্না জেসমিন রিভার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর এবার তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’
—নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রিভা। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার একটি অডিও ফাঁস হয়। অডিওতে শোনা যায়, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় চতুর্থ বর্ষের কিছু ছাত্রীকে আবাসিক হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। বিতর্কিত ওই অডিওর জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। তবে এই অডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তিনি মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) হলের নিজ কক্ষে দুই ছাত্রীকে ৭ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। তাদের বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ আছে।
এ ঘটনার প্রায় ৭ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় ওই দুই ছাত্রীকে নিজের হেফাজতে নিয়ে আসেন রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা। এ সময় সেখানে কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রীও উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, কলেজ অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ইত্তেফাকের হাতে আসা সে সময়ের আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রী ভুক্তভোগীদের একজনের কাছে জানতে চান, রিভা (ছাত্রলীগ সভাপতি) তাদের সঙ্গে কী করেছেন, তাদের কাছে কী জানতে চেয়েছেন। তখন এক ভুক্তভোগী তাদের বলেন, ‘আপু, আপনারা এখন ভিডিও করছেন, এই ভিডিওগুলো বাইরে গেলে আবার আমাদের ঝামেলা হবে। আরও কয়েকটা বছর এই হলে থাকতে হবে।’ এই কথা বলেই সেই ভুক্তভোগী কেঁদে ফেলেন। পরে সেই নেত্রীরা তাদের কিছু হতে দেবেন না বলে আশ্বস্ত করেন।
এদিকে ভুক্তভোগীদের হল থেকে চলে যেতে বলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই ভুক্তভোগীরা যে অভিযোগ করেছেন সেটির তদন্ত না করে উল্টো অভিযোগকারীদের হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কলেজ প্রশাসন নতজানু আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এখন থেকে আর কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ করার সাহস করবে না। হল প্রশাসনই সেই পথ বন্ধ করে দিল।’
এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভাকেও বারবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।-ইত্তেফাক

Related posts

Leave a Comment