শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য বালুভর্তি জিও টিউব দিয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত ঘিরে রাখে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল ঢেউয়ের তোড়ে যেন জিও টিউব সরে যেতে না পারে। সৈকতের বালু খুঁড়ে জিও টিউবের বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি ঢেউয়ের তোড়ে বালুভর্তি জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে সৈকতে।
এগুলোর জন্য বালু তোলায় সৃষ্টি হওয়া বড় বড় গর্তে সমুদ্রসৈকত পরিণত হয়েছে মারণফাঁদে।
ফলে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। এ অবস্থায় সৈকতে নামতে সাহস পাচ্ছে না পর্যটকরা। সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও প্রশাসনের টনক নড়েনি। সৈকতে সৃষ্টি হওয়া বড় বড় গর্তে পড়ে এক মাসের ব্যবধানে প্রাণ গেছে তিন পর্যটকের। এ কারণে পর্যটকরা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পর্যটন উদ্যোক্তারা।
গত ২২ আগস্ট বগুড়ার শাজাহানপুর থেকে মো. সবুজ (২৭) নামের এক পর্যটক কুয়াকাটা সৈকতে আসেন। ওই দিন দুপুরে সহকর্মীদের সঙ্গে গোসল করতে সমুদ্রে নেমে জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের ফাঁকে আটকে পড়েন তিনি। সেখানকার বড় একটি গর্তের পানিতে ডুবে মারা যান সবুজ। ২০ ঘণ্টা পর জেলেদের জালে ওঠে মরদেহ।
এর আগের দিন গত ২১ আগস্ট তিন বন্ধুর সঙ্গে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আসা মাহবুবুর রহমান পারভেজ (২৯)। প্রায় তিন ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পারভেজের মরদেহ উদ্ধার করেন। এ ছাড়া ২২ জুলাই সমুদ্রে গোসল করতে নেমে জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের ফাঁকে আটকে পড়ে পানিতে ডুবে মারা যায় ঢাকার বংশালের নাহিয়ান মাহাদী নাফী (১৫)। নাফীর বাবা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে কুয়াকাটায় এসে আমরা একটি হোটেলে উঠি। দুপুরের দিকে পরিবারের সঙ্গে সৈকতের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে সমুদ্রে গোসল করতে নেমে নাফী নিখোঁজ হয়। পরে উদ্ধার করে কুয়াকাটা হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ’ নাফী সাঁতার জানত দাবি করে নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘জিও ব্যাগের সঙ্গে নাফীর পা আটকে যায়। সে কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। ’
ঢাকার মিরপুর থেকে আসা পর্যটক আব্দুল্লা আল বাকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সৈকতের বালু দিয়ে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা ক্ষণস্থায়ী। বাঁধ নির্মাণের কিছুদিন পর সমুদ্রে তা বিলীন হয়েছে। কিন্তু তার অংশবিশেষ এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে, যেটা ভাটার সময় আমি দেখেছি। ইচ্ছা ছিল সৈকতে হাঁটব, গা ভেজাব; কিন্তু ভয়ে সৈকতে আর পা রাখিনি। ’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে নেমে পর্যটকরা সমস্যায় পড়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের সঙ্গে ঢেউয়ের ঝাপটায় আঘাত পেয়ে অনেক পর্যটক আহত হয়েছে।
ভাটার সময়ে সমুদ্র আরো সরে গিয়ে জেগে ওঠে সৈকত। সেই সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন জিও ব্যাগ ও জিও টিউব এখন মরণফাঁদ। সৈকত থেকে বালু খুঁড়ে নেওয়ায় তা ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি করেছে। জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়েছে গর্ত। সৈকতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ওই ছোট-বড় গর্তে ভাটার সময়ও হাঁটু সমান পানি থাকে। মূল সমুদ্রে যাওয়ার জন্য তা পেরিয়ে আরো দক্ষিণে যেতে হয় পর্যটকদের। কিন্তু সমস্যার শুরু হয় জোয়ারের সময়। ফেরার পথে সেই ছোট-বড় গর্ত পর্যন্ত আসতে না আসতেই জোয়ারের পানি ফুলতে শুরু করে।
আর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার না জানা পর্যটকদের কাছে ওই গর্তগুলো হয়ে ওঠে মরণফাঁদ। জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের ফাঁকে পা আটকে যায় তাদের। সেখানকার গর্তের পানিতে ডুবে মারা যায় পর্যটকরা। এ ছাড়া কখন জোয়ার আসবে, কখন ভাটা শুরু হবে—এসব তথ্য সৈকতে আসা পর্যটকদের কাছে পৌঁছায় না।আর তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেই সেখানে।
কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, ‘সৈকত রক্ষার নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড যা করছে তা এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রে গোসল করতে নেমে এ পর্যন্ত যে কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে, তা ওই জিও ব্যাগে আটকে গর্তে ডুবে যাওয়ার কারণেই। সৈকতের এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সতর্কতামূলক বোর্ড লাগানো প্রয়োজন। মাইকে প্রচার চাই। কিন্তু কোথায় সেসব?’
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য সৈকতে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব বসানো হয়েছে। এগুলোর জন্য সৈকত থেকে বালু উত্তোলন করা হয়েছে। পাউবোর ডিজাইন অনুযায়ী কাজটি করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করতে গিয়ে সৈকতে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি করেছে। গোসল করতে গিয়ে সেখানে পর্যটকরা সমস্যায় পড়ছে। যেখানে বিপজ্জনক গর্ত রয়েছে, সেখানে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা একটু সচেতন ও সাবধান হলেই দুর্ঘটনা এড়াতে পারে।