ইউক্রেনের ৪ অঞ্চল রুশ কবজায়

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেন এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে তাদের দ্রুত অন্তর্ভুক্তির অনুরোধ জানিয়েছে। গতকাল শুক্রবার রুশ প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নতুন করে মস্কোর ওপর অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে।
যুদ্ধের সাত মাস পূর্ণ হওয়ার কয়েক দিন পর গতকাল ভ্লাদিমির পুতিন চার বিজিত অঞ্চল সংযুক্তির ঘোষণা দিলেন।
এ ঘোষণার আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এ বিষয়ে কড়া অবস্থান তুলে ধরে আসছিল।
ক্রেমলিনে এসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলকে যুক্ত করার ঘোষণা দেন ভ্লাদিমির পুতিন। এ সময় তিনি দাবি করেন, গত শুক্রবার থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত গণভোটে ওই চার ইউক্রেনীয় অঞ্চলের মানুষ রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পক্ষে ব্যাপকভাবে রায় দিয়েছেন।
এর আগে ২০১৪ সালে কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে ইউক্রেনের মালিকানাধীন ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে একইভাবে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় মস্কো।
গতকাল অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেওয়ার পর অধীকৃত চার অঞ্চলের চার রুশপন্থী নেতা পুতিনের সঙ্গে হাত মেলান। ওই চার নেতা হলেন খেরসনের ভ্লাদিমির সালদো, জাপোরিঝিয়ার বালিস্কি, দোনেস্কের দেনিস পুশিলিন এবং লুহানস্কের লিওনিদ পাশিচনিক। ক্রিমিয়া উপদ্বীপে রাশিয়া আগ্রাসন চালালে সেখানকার রুশপন্থী নেতারাও মস্কোর সমর্থনে এভাবে সক্রিয় ছিলেন।
গতকাল অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দিয়ে পুতিন বলেন, ‘আমি কিয়েভ এবং তার পশ্চিমা প্রভুদের উদ্দেশে বলতে চাই, লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলের জনগণ চিরদিনের জন্য আমাদের নাগরিক হয়ে গেল। ’ পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে চারটি অঞ্চল সংযুক্তির ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন।
পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসঙ্গও তোলেন। তিনি বলেন, রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনর্গঠনের কোনো পরিকল্পনা করছে না। সোভিয়েত নেতারা দেশকে ধ্বংস করেছেন দাবি করে পুতিন বলেন, ‘ইউএসএসআর আর নেই। আমরা অতীত ফিরিয়ে আনতে পারি না। তা প্রয়োজন নেই। ’
এর পরপরই টেলিগ্রামের পোস্টে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি গতকাল বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে জোটে (ন্যাটো) যোগ দেওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করেছি। জোটে দ্রুত যোগ দেওয়ার আবেদন স্বাক্ষর করে আমরা একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ’
এরপর গতকালই আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন জেলেনস্কি। প্রসঙ্গত, ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বিরোধ যুদ্ধে গড়ায়।
এই চার অঞ্চল ইউক্রেনের সমগ্র ভূখণ্ডের প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ। শতাংশের হিসাবে তা ১৫ থেকে ১৮ ভাগ (অর্থাৎ প্রায় ২০ ভাগ)। চার অঞ্চলে রাশিয়া পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেটি পূর্বদিকে লুহানস্ক থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত যুক্ত করে দীর্ঘ একটি ভূখণ্ডকে এক সুতোয় গাঁথবে।
ন্যাটো বলছে, ন্যাটোর মিত্ররা ইউক্রেনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য তাদের ‘অবিচল সমর্থন’ নিশ্চিত করেছে। জোটের মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ইউক্রেনকে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবে না ন্যাটো।
গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ১৯৪৫ সালের পর ইউরোপে এত বড় অঞ্চলে কোনো দেশ দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। গতকাল রাশিয়া সেই ব্যতিক্রমধর্মী কাজটি করার ঘোষণা দিল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাশিয়া ফেডারেশনে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে ওই সব এলাকায় ইউক্রেনসহ অন্যদের সামরিক তৎপরতাকে রাশিয়ার ভূখণ্ডে আক্রমণ হিসেবে দেখবে মস্কো।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এখন কী হবে। পুতিন আগেই বলেছেন, নতুন ভূখণ্ডে কারো হামলা রাশিয়ার ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখা হবে। তাতে প্রয়োজনে রাশিয়া যেকোনো অস্ত্র ব্যবহার করবে। গতকালের ভাষণে পুতিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জাপানে ১৯৪৫ সালে পরমাণু বোমা হামলা চালিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ বিষয়টি পশ্চিমাদের নজর এড়াবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির বিষয়ে পশ্চিমারা তো বটেই, রুশদেরও উদ্বিগ্ন করেছে। মূলধারার একটি রুশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে হুমকি দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করা হয়।

প্রতিক্রিয়ায় নতুন অবরোধ
গতকাল পুতিনের ঘোষণার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘এই পদক্ষেপের কোনো বৈধতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানাকে সম্মান করে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, নতুন করে আরোপ করা অবরোধের আওতায় ৯ শতাধিক রুশ নাগরিকের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, উপপ্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আইনসভার নিম্নকক্ষ স্টেট ডুমার ১০৯ জন আইন প্রণেতাসহ আরো অনেকে।
নতুন অবরোধের ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের এই জঘন্য লঙ্ঘনের জন্য রুশ সরকারকে অবশ্যই দায়ী করতে হবে। ’ অবরোধের অংশ হিসেবে রাশিয়ায় সাত শর মতো পণ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন টুইটারে লেখেন, ‘পুতিন কর্তৃক ঘোষিত অবৈধ অন্তর্ভুক্তি কোনো কিছুই পরিবর্তন করবে না। রুশদের দখল করা সব ভূমি ইউক্রেনের এবং তা এই সার্বভৌম দেশেরই থাকবে। ’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান কূটনীতিক জোসেফ বরেল গত সপ্তাহে বলেছিলেন, রাশিয়া ‘অবৈধ গণভোট’ আয়োজন করেছে।

জাতিসংঘের নিন্দা
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৃহস্পতিবার রাশিয়ার সংযুক্তি পরিকল্পনার নিন্দা জানান। তিনি সেদিন বলেন, ‘রাশিয়ার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, বেআইনি এবং সবার এর নিন্দা করা উচিত। ’ তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যদের একটি হয়েও রাশিয়া জাতিসংঘ সনদ রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছে না।

জাতিসংঘে ফ্রান্সের তৎপরতা
ফ্রান্স জানিয়েছে, রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়ার নিন্দা জানানোর উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব আনা হবে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সময় অনুযায়ী, গতকাল দিবাগত রাতের প্রথম ভাগেই প্রস্তাবটি পরিষদে ওঠার কথা। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ফ্রান্স এবং আলবেনিয়া প্রস্তাবের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে রাশিয়ার ‘ভেটো’ ক্ষমতার কারণে প্রস্তাবটি পাস হবে না, যা আগেই অনুমান করা যায়।

রাশিয়া ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্তির আরো কাজ বাকি
ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণার মধ্য দিয়েই অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। এখনো রাশিয়ার সাংবিধানিক স্বীকৃতি বাকি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আগামী সপ্তাহে রাশিয়ার আইনসভার দুই কক্ষে ভূখণ্ড সংযুক্তির চুক্তিগুলো উপস্থাপনের পর তা পাস হবে। এরপর সাংবিধানিক অনুমোদন হবে।

সূত্র : গার্ডিয়ান, বিবিসি

Related posts

Leave a Comment