ইনসানে কামিল

– ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান

এখলাস বা বিশুদ্ধ নিয়্যত

 

আল্লাহর হাবীব (সাঃ) ফরমায়েছেন-
“নিশ্চয় সমস্ত (ভাল) কর্মের (পারলৌকিক) ফলাফল নিয়্যতের বিশুদ্ধতার উপর নির্ধারিত হয়ে থাকে।”

মানুষ যে নিয়্যতে কাজ করবে সে অনুযায়ী তার কার্মের প্রতিফল পাবে। অতএব যে কাজটি করবে তার জন্য প্রথমেই দেখতে হবে কাজটি করার জন্য আল্লাহ পাকের নির্দেশ আছে কিনা? যদি থাকে তবে সেটা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ় ভাবে নিয়্যত করতে হবে। তারপর কাজটি ভালভাবে বুঝে চিন্তা করে দেখতে হবে আল্লাহর হাবীব তা কেন, কি ভাবে এবং কখন করতে বলেছেন? এরপর দেখতে হবে, কাজটি ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত না মোস্তাহাব অর্থাৎ কাজটি কোন পর্যায়ের। মোটকথা, সব কাজ একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার নিয়্যতে স¤পন্ন করতে হবে। নয় তো কোন কাজই করা যাবে না। এরই নাম খাঁটি নিয়্যত বা এখলাস।
এলমে দ্বীন ছাড়া এবাদত কি, কেন করতে হবে, করলে কি হবে, না করলেই বা কি হবে, কি ভাবে করলে আল্লাহ পাক পছন্দ করবেন, আর এতে কতটুকু সওয়াব মিলবে তার কিছুই জানা যায় না। এলেম ছাড়া এবাদত করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি খাঁটি নিয়্যত ছাড়া কোন এবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া কখনও সম্ভব নয়।

রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
“তাদেরকে এটাই আদেশ করা হয়েছে যে, তারা যেন খাস করে (একমাত্র) আল্লাহর জন্য এবাদত করে এবং তৎসঙ্গে অন্য কিছুর (অন্য কারও) এবাদত না করে।”
যদি কেউ কোন ভাল কাজ মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য করে অথবা লোকের প্রশংসা পাওয়ার আশায় করে তবে তা রিয়া বলে গণ্য হবে। এরূপ নিয়্যতে ভাল কাজ করলেও কঠিন গুনাহগার হতে হবে। ফলতঃ অন্তর হতে এই রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে দূর করে নেয়ার নামই এখলাছ। বান্দার সমস্ত কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় করতে হয়। দুনিয়ার কোন লোভ লালসা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে যত বড় নেক কাজই করুক কিংবা যতবড় ত্যাগ স্বীকারই করুক না কেন, আল্লাহর নিকট তার এক কানা কড়িও মূল্য নেই।

হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসুল বলেছেন-
“আল্লাহ তোমাদের চেহারা সুরাত, ধন দৌলতের দিকে তাকান না বরং তিনি তোমাদের অন্তর আর কার্যাবলীর দিকে তাকান।” (মুসলিম শরীফ)
তাঁর বর্ণিত আর একটি লম্বা হাদিসের ব্যাখ্যা নিম্নে দেয়া হলো। রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন-
“শেষ বিচারের দিনে সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির বিচার করা হবে তিনি হলেন শহীদ। তাকে আল্লাহর দরবারে হাজির করে তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সে সেই সব নিয়ামত প্রাপ্তির কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- তুমি দুনিয়াতে আমার এতসব নিয়ামত পেয়ে তা ভোগ করার পর আমার জন্য কি কাজ করেছ? সে বলবে- হে বারে এলাহি! আমি আপনার পথে (দ্বীনের পথে) লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়ে গেছি। তখন আল্লাহ পাক বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি বীর পুরুষ হিসাবে খ্যাতি লাভ করার জন্য এই লড়াই করেছো, জ্বিহাদ করেছ। আর সে কাজের সুনাম তুমি দুনিয়াতেই প্রাপ্ত হয়েছো।
তখন আল্লাহ পাকের নির্দেশে পা ধরে উপুর করে টেনে-হিচরে ফেরেশতাগণ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।
এরপর হাজির করা হবে একজন আলেমকে যিনি এলেম শিক্ষা করেছেন, আল্লাহর কালাম পাঠ করেছেন। তাকেও তার প্রতি প্রদত্ত আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে। সে ব্যক্তি ঐসব নিয়ামত প্রাপ্তির কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- তুমি দুনিয়াতে আমার এত সব নিয়ামত ভোগ করে আমার জন্য কি কাজ করেছো? সে বলবে, আমি এলেম হাসল করে মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য আল-কোরআন পাঠ করেছি। তখন আল্লাহ পাক বলবেন- তুমি মিথ্যাবাদী। কেননা, দুনিয়ায় আলেম রূপে খ্যতি লাভ করার জন্য, সম্মান পাওয়ার জন্য এলেম হাসিল করেছ। সেই খ্যাতি ও সম্মান তুমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেছো। কাজেই, তার প্রতি আল্লাহর ফয়সালা হলো- তাকেও উপুর করে পা ধরে টেনে হিচরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা।
তারপর হাজির করা হবে দুিনয়ার একজন ধনবান ব্যক্তিকে। তাকে তার প্রতি প্রদত্ত আল্লাহর নিয়ামতের কথা স¥রণ করিয়ে দেয়া হলে সে প্রাপ্তীর কথা স্বীকার করবে। তখন তাকেও জিজ্ঞাসা করা হবে- আমার দেয়া এসব নিয়ামত ভোগ করার পর দুনিয়াতে তুমি আমার জন্য কি করেছো? সে বলবে- ইয়া আল্লাহ! আমি দুনিয়ায় তোমার পছন্দনীয় সকল খাতেই আমার স¤পদ খরচ করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন- তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি দুনিয়াবাসী লোকের কাছে দাতা হিসাবে খ্যাতি লাভ করার জন্য দান করেছ। সে খ্যতি, সে সম্মান তুমি দুনিয়া হতেই প্রাপ্ত হয়েছ। আখেরাতের জন্য কিছুই রাখনি। এবার তাকেও পা ধরে উপুর করে টেনে হিচরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার ফয়সালা দেয়া হবে।” (মুসলিম শরীফ)

উপরোক্ত ৩টি বর্ণনা দ্বারা এ সত্যটিই সু¯পষ্ট ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, হাশরের দিন কোন নেক কাজের বাহ্যিক রূপের উপর ভিত্তি করে কাউকে কোন পুরস্কারের ফয়সালা দেয়া হবে না। যে সমস্ত সৎ কাজ শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় এখলাসের সাথে করা হবে একমাত্র সেই সকল কাজই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলে আল্লাহর দরবারে বিবেচিত হবে। লোক দেখানো, নাম কুড়ানো, সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি ও প্রভাব বিস্তার করা উদ্দেশ্যে যত বড় যত মহৎ যত টাকাই খরচ করা হোক না কেন, আল্লাহর শাহী দরবারে তার কোন গুরুত্ব নেই। বিনিময়ে এক কানাকড়ির মূল্যও সে পাবে না। নকল বা অচল টাকা যেমন বাজারে কেউ গ্রহন করে না, তেমনি সহীহ বা এখলাস পূর্ণ নিয়্যত না হলে অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহকে খুশী করার ইচছায় করা না হলে সে কাজ যত বড় যত ভালই হোক, রাব্বুল আলামীন তা গ্রহন করবেন না।

আল্লার দরকবারে আমল পৌঁছানোর সিড়ি হলো এখলাস পূর্ণ নিয়্যত। আর মকবুলিয়াত হওয়ার প্রদান শর্ত হলো খাঁটি ঈমান ও একীন। অতএব ঈমানের মধ্যেও খাঁটি একলাস পয়দা করতে না পারলে আমাদের মুক্তির আশা করা কঠিন।

তারপরও মুসলমানের পথ খাঁটি তওবা এবং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার আশা-
“লা তাক নাক না তু মির রাহমাতিল্লাহ- নিরাশ হয়ো না আল্লাহর রহমত লাভের আশা হতে।”

(চলবে——–)

Related posts

Leave a Comment