ইনসানে কামিল

-ডাঃ মৌলভী কাজী আবদুর রহমান

ইবাদত বন্দেগী

চার
রাব্বুল আলামীন ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর এবাদত বন্দেগী করার জন্য। এবাদত-বন্দেগী বলতে আল্লাহ পাকের নির্দেশ মোতাবেক ফর্মাবর্দারীকে বুঝায়। আল্লাহর আদেশ মেনে মানুষ যে সব কাজ করে, তাকে বলে এবাদত। আর যারা এবাদত-বন্দেগী করে তাদের বলা হয় আবিদ।
বন্দেগী শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এই শব্দের মধ্যে আত্মার বিলীনতা বুঝায়। আল্লাহ পাক বলেছেন-
“অর্থাৎ আমি জীন ও ইনসান জাতিকে কেবল আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।”
এছাড়া নবী ও রাসুলগণের কাজ হলো, বান্দাগণকে তার নিজ পরিচয়, সৃষ্টি কর্তার পরিচয়, মাখলুকাত সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং তার রহস্য সম্বন্ধে জ্ঞাত করা। মনিবের সাথে গোলামের আন্তরিকতা পূর্ণ যোগসূত্র স্থাপন করা, গোলামের করণীয় কার্যাদি ও কর্তব্য বাস্তবায়নের নিয়ম-পদ্ধতি সঠিক ভাবে শিখিয়ে বুঝিয়ে তাদেরকে করণীয় কার্যে নিয়োজিত করা।
আল্লাহর পিয়ারা দোস্ত রাসুলে করিম (সাঃ)- এর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ও মহব্বত স্থাপন করে যথার্থভাবে তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করার নামই “ আল্লাহর ইবাদত”। অন্য কথায়, যে সকল কাজ আল্লাহর হাবীব নিজে করে গিয়েছেন এবং উম্মতগণকে করতে নির্দেশ দিয়েছেন- তাই এবাদত। আর যে সকল কাজ তিনি নিজে করেননি বা করতে বলেননি, এমনকি আসহাবগণও করেননি ঐ সকল কাজ অবশ্যই বর্জনীয়। আল্লাহ পাক পরিষ্কার ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন-
“হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা আমার দোস্তনবী মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহর (সাঃ)- এর পাইরুবী কর, তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ কর।”
আল্লাহর হাবীবের তরিকার বাইরে নিজের খেয়াল খুশী মত আপাতঃ দৃষ্টিতে যত ভালো কাজই মনে হোক না কেন, তা কিছুতেই করা যাবে না। কারণ, আল্লাহ তা পছন্দ করেন না এবং কবুলও করেন না। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা পছন্দ করেন না তা এবাদত বলে গন্য হতে পারে না। আল্লাহর পাক আরো বলেছেন-
“আমি মানুষ জাতিকে আমার প্রতিনিধি করে সৃষ্টি করেছি, তারা আমার এবাদত করবে এবং উলুহিয়াত ও রাবুবিয়াত দুনিয়ার সর্বত্র প্রচার এবং প্রকাশ করবে। আমার দেয়া খেলাফতের দায়িত্ব পালন করবে। আর আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছি মানুষ জাতির কল্যাণের জন্য।”
এবাদতের প্রধান উৎস রাসুলুল্লাহ (সাঃ)- এর পরিচয় এবং চরিত্র সম্বন্ধে ভালো ভাবে অবগত হয়ে তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করা কর্তব্য। তাতে মনে দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন-
“অর্থাৎ হে আমার হাবীব! (আপনি মানুষদেরকে) বলে দিন যে তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার পাইরুবী কর। (তাবেদারী কর, আমার সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণ কর) তা হলে আল্লাহপাক তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের সমস্ত গুনাহ রাশি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ পাক অত্যন্ত ক্ষমতাশীলও দয়ালু।”
(পাড়া ৩ সুরা আল এমরান, আয়াত ৩১)
আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেছেন-
অর্থাৎ যারা আল্লাহ ও রাসুলের তাবেদারী করবে তারা পরকালে ঐ সমস্ত লোকের সাথে থাকবে যাদেরকে আল্লাহ পাক পুরস্কৃত করেছেন।
আল্লাহর মেহেরবাণীতে আম্বিয়া, সিদ্দিকীন, শহীদান ও নেককারগণ (হাশরের দিন) হবে সাথী (কি উত্তম হবে তাদের সাথী সকল)! আল্লাহ পাক প্রত্যেকের আমল স¤পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।

মহব্বত কারতু পয়দা ও নামে খোদা
মহব্বত কারতু পয়দা ও নামে রাসুল।
ইব্রাহীম কোরবাণী কিয়া ও নামে খোদা
ইসমাঈল কোরবাণী হুয়া ও নামে খোদা।
জান ও মালছে হো ফিদা ও নামে খোদা
সব কুচ লুটা দেতু ও নামে খোদা।

নবী করীম (সাঃ)- এর ইত্তেবা, অনুসরণ ও অনুকরণই উম্মতে মোহাম্মদীগণের জন্য আল্লাহর এবাদত। মুক্তির পথ। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জান্নাতের সার্টিফিকেট। আল্লাহ পাক বলেছেন-
“অর্থাৎ রাসুল (সাঃ) তোমাদিগকে যা দিয়েছেন, তা গ্রহন কর এবং তিনি যে বিষয়ে নিষেধ করেছেন তা হতে দূরে থাক।”
(২৮ পাড়া, সুরাতুল হাশর, আয়াত ৭)
অর্থাৎ তোমাদের জীবন নবী করিম (সাঃ)- এর সুন্নাতী তরিকার উপর প্রতিষ্ঠিত করো।
ইবলিশ বা শয়তানের পরিচয়
জ্বীন জাতি এবং এই ইবলিশ স¤পর্কে আমরা পূর্বেই কিছুটা অবগত হয়েছি। জ্বীন জাতির বংশধর ইবলিশ আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে বাঁচার অধিকার পেয়ে ফেরেশতাগণের সঙ্গে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং সাথে সাথে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করে। একাগ্রতার সাথে আল্লাহর এবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর তরফ হতে অনেক নিয়ামত অর্জন করে। জানা যায়, সে ছয় লক্ষ বৎসর আল্লাহ পাকের এবাদত করেছিলো ।
আল্লাহ পাক তার এবাদতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ফেরেশতাগণের ওস্তাদ (মুয়াল্লিম মালায়িকাত) উপাধিতে ভুষিত করেছিলেন। তাই হয়ত অন্য জাতি হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ পাক তাকে ফেরেশতাগণের সঙ্গেই শুমার করেছিলেন। কিংবা আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের গুরুত্ব বুঝানোর নিমিত্ত্বে তাঁর খলিফার অনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করাকে একান্ত প্রয়োজন ভেবে ইবলিশকেও ফেরেশতাগণের সঙ্গে হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা করার হুকুম প্রদান করেছিলেন।
এই “সিজদা” উব্দিয়াতের উদ্দেশ্যে নয়। উব্দিয়াতের সেজদা খাস করে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ এ সেজদা পেতে পারে না। আর কেউ এ সিজদা পাওয়ার যোগ্যও নয়। যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে পূজ্য বা আরাধ্য হিসাবে সিজদা করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে।
এখানে হযরত আদম (আঃ) কে- সিজদা করার জন্য আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের প্রতি যে হুকুম দিয়েছেন তা উবদিয়াতের সিজদা নয়। এ সেজদা শুধু আনুগত্য, বশ্যতা, বিনয়, নম্রতা এবং নেতা বলে মেনে নেয়ার উদ্দেশ্যে।
অপর দিকে, উবদিয়াতের সিজদা হলো- ইবাদতের উদ্দেশ্যে একমাত্র আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে কপাল মাটিতে স্থাপন করা। যেমন, আমরা নামাজের মধ্যে করে থাকি। এ হলো ইবাদতের সেজদা।
আদমকে যে সিজদা করা হয়েছে তা হলো- বিনয়ী বা অনুগত হওয়ার নিদর্শন। বশ্যতা স্বীকার করা বা নেতা বলে মেনে নেয়া। এ হলো, মান্যতা ও আনুগত্যের নিদর্শন। কিন্তু ইবলিশ তা করলো না। সে অহঙ্কারের বশে আল্লাহর নির্দেশের অবাধ্য হয়ে, বশ্যতা স্বীকার না করে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া হতে চির বঞ্চিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে গেলো।
আর এদিকে হযরত আদম (আঃ) এবং মা হাওয়াও (আঃ) একটি মাত্র ভুল করে ফেলেন। শয়তানের ধোঁকায় পরে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেলেন তাঁরা। তারপর অপরাধ বুঝতে পেরে আল্লাহর দরবারে অপরাধ স্বীকার করে লজ্জিত হন। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে কেঁদে কেঁদে বক্ষ ভাসিয়ে ক্ষমা চান। কিন্তু এই ক্ষমা পাবার আশায় কত কাল, কত যুগ যে পার হয়ে গেছে তার হিসাব করলে ভয়ে চিত্ত কেঁপে উঠে!
কাঁদত কাঁদতে শেষে একদিন তাঁরা ক্ষমা লাভ করেন, হারানো ধন বেহেশত লাভের হুকুম পান। কিন্তু ইবলিশের ভাগ্যে আল্লাহর ক্ষমা জুটেনি। আর ক্ষমা না পাওয়ার কারণগুলো ছিলো নিম্নরূপ-
১। ইবলিশের অন্তকরণে ছিলো আত্ম-অহঙ্কার ও পরের অনিষ্ট চিন্ত। অন্যায়-অপরাধকে, অন্যায় অপরাধ বলে স্বীকার না করা। আল্লাহর হুকুমকে অবজ্ঞা করা। সর্বোপরি আল্লাহর রায়ের বিরুদ্ধাচরণ করা, ইত্যাদি।
২। আদমের অন্তরে ছিলো অন্যায়-অপরাধের জন্য গভীর অনুতাপ। ছিলো বিদগ্ধ অনুশোচনা, অপরিসীম লজ্জা, আল্লাহর আযাবের ভয়, ক্ষমা প্রার্থনা ও ক্ষমার আশা এবং ভবিষ্যতে আর অবাধ্য না হওয়ার ওয়াদা। এটাই আদম ও মা হাওয়ার মুক্তি “সনদ,” যা নির্ধারিত হয়েছে দুনিয়াবাসীর সকল মানুষের জন্য ক্ষমা ও মুক্তি পাওয়ার দিশারী হিসাবে।( চলবে—–)

Related posts

Leave a Comment