বঙ্গবাজারে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানো আর দেনা নিয়ে এখন যত চিন্তা

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:
এমনিতেই নিত্যদিন দোকানে দোকানে হুমড়ি খেতেন ক্রেতা। সকাল থেকে রাত– মানুষে গমগম করত গুলিস্তানের বঙ্গবাজার। এখানকার পোশাক ছড়িয়ে পড়ত দেশের নানা প্রান্তে, শহর থেকে অজপাড়াগাঁয়ে। ঈদ উৎসব ঘিরে তা হয়েছিল আরও জমাট; ছিল না পা ফেলার জো। দেশের অন্যতম প্রধান এই পোশাকের বাজারে নতুন কাপড় ছড়াত সুরভি। এক দিন আগেও কাপড়ে ঠাসা ছিল সব গুদাম আর দোকান। এখন ‘পোশাক-রাজ্য’ বঙ্গবাজার পুরোটাই বিরান। নতুন পোশাকের মৌতাতের বদলে বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ।

থেমে গেছে ব্যবসায়ীদের চাঞ্চল্য, নেই বিকিকিনির ব্যস্ততা আর হাঁকডাক। মঙ্গলবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বঙ্গবাজার এখন ধ্বংসস্তূপ, নিঃস্ব ব্যবসায়ীদের চোখের নোনাজল মেশানো একখণ্ড পোড়া জমি। সেখানে এখন আর ক্রেতা নেই, পড়ছে কেবল সর্বস্বান্ত ব্যবসায়ীদের পা। কেউ চাপড়াচ্ছেন বুক, কারও চোখে নীরবে বইছে জল। দুঃসময়ে ধ্বংসস্তূপের ছাই উড়িয়ে নিজের স্বপ্নের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পোড়া ভিটায় অনেকে হাতড়াচ্ছেন সুসময়ের স্মৃতি।

সর্বগ্রাসী অনল বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের চোখে-মুখে এঁকে দিয়ে গেছে ঘুরে দাঁড়ানো আর দেনা শোধের চিন্তারেখা। অনেকেই ব্যাংক, এনজিও থেকে ঋণ এবং আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে দোকানে নতুন মালপত্র তুলেছিলেন। এখন সব হারিয়ে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে বঙ্গবাজারেই পুনর্বাসন চান ব্যবসায়ীরা।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আশপাশের আট মার্কেটের অন্তত পাঁচ হাজার দোকান ছাই হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৪৮ ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও আগুন লাগার কারণ নিয়ে গতকাল বুধবার পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে চাননি কেউ। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আদর্শ মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত। এক দিন পার হলেও বঙ্গবাজারসংলগ্ন এনেক্সকো টাওয়ার থেকে গতকালও ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ওই টাওয়ারে পানিও ছিটান। এনেক্সকো ভবনের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলা থেকে একের পর এক পোশাকভর্তি বস্তা নিচে ফেলা হচ্ছিল। এর পর তা ব্যবসায়ীরা নিরাপদে সরিয়ে নেন। বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপের বিভিন্ন জায়গায় গতকালও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পানি ছিটাতে দেখা গেছে। এনেক্সকো ভবনের নিরাপত্তাপ্রধান আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ভোরে আগুন দেখে পাশের মসজিদ থেকে মাইকিং করে সবাইকে সর্তক করা হয়। এ সময় ফায়ার সার্ভিসকেও জানানো হয়।’ এদিকে আগুনের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। তবে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে আগুনের সূত্র খোঁজার চেষ্টা করছে।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন সমকালকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরে মামলার প্রস্তুতি চলছে। জড়িতদের আমরা শনাক্ত করব।’

ব্যবসায়ীদের হাহাকার : গতকাল সকাল থেকে বঙ্গবাজার লাগোয়া ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের সামনের সড়কে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। ওই তালিকায় নাম তুলতেও ছিল লম্বা সারি। সেখানে রাস্তার পাশে একটি বেঞ্চে নির্বাক বসে ছিলেন ‘প্রিন্স কিডস জোন’ নামে দোকানের মালিক মো. ইয়াছিন। তিনি জানান, তাঁর দোকানে ৩৬ লাখ টাকার পোশাক ছিল। ক্যাশবাক্সে ছিল ৩ লাখ টাকা। একটা সুতাও দোকান থেকে বের করতে পারেননি তিনি। পুড়ে গেছে নগদ টাকাও। যেসব পার্টির কাছ থেকে পাইকারি পোশাক কিনে ঈদ ঘিরে দোকান সাজিয়েছেন; তাঁরা পাবেন ২০ লাখ টাকা। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করেছেন ১০ লাখ টাকা। এসব দেনা কীভাবে শোধ করবেন– কোনো কিনারাই দেখছেন না তিনি। ২০১৪ সাল থেকে লড়াই করে তিনি যে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন, এক আগুনে সব শেষ হয়ে গেছে। ইয়াছিন বললেন, ‘কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও আমার শুকিয়ে গেছে। আগুন লাগার খবর পেয়েই দোকানে ছুটে আসি। দেখি দাউদাউ করে জ্বলছে। ঢোকার কোনো উপায় ছিল না। এই দোকানের ওপরেই পুরো সংসার। আবার কীভাবে শুরু করব, জানি না। সরকার যদি পাশে না দাঁড়ায়, আমাদের স্বপ্ন এখানেই শেষ হবে। আমার চেয়েও বড় অনেক ব্যবসায়ী ছিলেন, যাঁরা এক দিন আগেও কোটিপতি ছিলেন; আজ তাঁরা নিঃস্ব।’ তবে ‘রাফি-রায়হান ফ্যাশন’-এর কর্ণধার শাহিদ হোসেনের গল্প আরও মর্মস্পর্শী। বঙ্গবাজারে বোনের দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছিলেন তিনি। টলমল চোখে শাহিদ বলেন, ‘পরিবারের সবাই হতভম্ব। আজ সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেও দুই সন্তানের গলা জড়িয়ে কান্নাকাটি করেছি। সংসার, সন্তানদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি– কীভাবে চলব আমরা! করোনার কারণে অনেক দিন ব্যবসা ভালো ছিল না। দোকানের ভাড়া বাকি আছে তিন বছরের। স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ঈদের বাজারটা ধরার চেষ্টা করেছি। ব্যবসা করে ধার শোধ করার কথা ছিল।’

একই মার্কেটে আলাদা চারটি দোকান ছিল আরফান শুভ এবং তাঁর তিন ভাই ফারুক হোসেন, মনজুরুল ইসলাম ও মাকসুদুর রহমানের। পোড়া দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে শুভর আর্তনাদে আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছিল। তিনি জানান, এনজিও থেকে তিনি ঋণ নিয়েছেন। আত্মীয়ের কাছ থেকে নিয়েছেন ধার। দোকানের ওপরেই চার ভাইয়ের সংসার। বাবা নেই, মা অসুস্থ। ঈদের পর শুভর বিয়ে করার কথা ছিল।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নুরুজ্জামান ও তাঁর বন্ধু বাবুল মাত্র এক মাস আগেই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে দোকান নেন। নুরুজ্জামান জানান, দোকান ও গুদাম মিলে ৪০ লাখ টাকার মতো পোশাক ছিল। ৭ হাজার পিস জিন্স প্যান্ট ছিল তাঁদের। আর কালিয়াকৈরের এক পাইকারি পার্টি তাঁদের কাছে ১২ লাখ টাকা পাবে। বঙ্গবাজারের বিভিন্ন দোকান মালিকের কাছে তাঁর পাওনা আছে ২২ লাখ টাকা।

লুটপাটের অভিযোগ : ঘটনাস্থলে দেখা যায়, বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপ থেকে যে যার মতো পোড়া জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে। তবে পোড়া টিন, লোহা, ক্যাশবাক্স ও কাপড়চোপড় সরিয়ে নেয় বাইরের লোকজন। দিনভর অসংখ্য লোক ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে পোড়া কাপড় খুঁজছিল। কেউ মাথায়, কেউ হাতে করে, আবার কেউবা ভ্যানে মালপত্র নিয়ে যাচ্ছে। তবে এসব পোড়া জিনিস কার– এর কোনো নজরদারি নেই। পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প সেখানে তৈরি করা হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মো. হারুন নামে একজন বলল, কুড়িয়ে পাওয়া এসব মালপত্র ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করে দেবে। জয়নব বিবি নামে এক নারী তার দুই সন্তান নিয়ে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে মালপত্র কুড়াতে আসে। সে জানায়, কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসপত্র বিক্রি করবে। আবার স্বেচ্ছাসেবী ও আশপাশের লোকজনকে দেখা যায় কয়েক টোকাইকে মারধর ও শাসাতে।

তালিকা তৈরির কাজ শুরু : বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মহানগরী মার্কেটের মাইমুনা গার্মেন্টের মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এই মার্কেটের ছোট ব্যবসায়ীদের একজন আমি। আমারও পাঁচ লাখ টাকার মালপত্র পুড়েছে। ঈদ উপলক্ষে বাকিতে মালপত্র দিয়েছিলাম ১০ লাখের মতো। ওই খাতাও নেই। সম্পদ বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তালিকায় নাম লেখাতে এসেছি। দেখি, কোনো সাহায্য পাই কিনা।’ আল মদিনা গার্মেন্টের মালিক নেয়ামাত বলেন, ‘বড় স্বপ্ন নিয়ে দেড় বছর আগে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সব শেষ। এখন সাহায্যের খাতায় নাম লেখাতে হবে– ভাবতে পারিনি।’

ব্যবসায়ীরা জানান, আদর্শ হকার্স মার্কেট, মহানগরী, বঙ্গ ও গুলিস্তান– এই চার অংশ মিলেই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। সিটি করপোরেশনকে ‘সালামি’ দিয়ে দুই দফায় দুই হাজার ৯৬১ জন দোকান বরাদ্দ নেন। প্রায় ২২ হাজার বর্গফুটের এই মার্কেটে ৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় দোকান রয়েছে। এনেক্সকো টাওয়ারের আরেকজন ব্যবসায়ী করিম খান। তিনি বলেন, ‘আমার দোকান পাঁচতলায়। ৫০ লাখ টাকার মাল ছিল আমার দোকানে। সবই শিশুদের পোশাক। অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যেটুকু পারি, নামানোর চেষ্টা করছি। নতুন করে ব্যবসায় ফিরতে চাই। এ জন্য চাই সরকারের কাছে সহযোগিতা।’

ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা : রাজধানীর মার্কেটগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় যাতে আধুনিক ও নিরাপদ মার্কেট হতে পারে, সিটি করপোরেশন সে ব্যবস্থা নেবে। আগুন লাগার দু-তিন মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট এলেও নানা কারণে তারা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঈদ টার্গেট করে অনেকেই বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মালপত্র তুলেছিলেন। এখন ভয়াবহ আগুনে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী সবসময় তদারকি করছেন। এটি নিয়ে কী করা যায়, পরবর্তী সময়ে তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন। ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন বিষয়ে সিটি করপোরেশন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে। পানির সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসকে আমরা ঢেলে সাজাচ্ছি। পানির ব্যবস্থা থাকার জন্য সিটি করপোরেশন ও রাজউক ব্যবস্থা নেবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বিএনবিসি কোড অনুযায়ী, একটি মার্কেট বা স্থাপনা অথবা ভবনে যত মানুষ থাকে, সেই অনুপাতে বাহির ও প্রবেশপথের সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা। আমার কাছে আপাতদৃষ্টিতে টিকাটুলীর রাজধানী সুপার মার্কেট এবং নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। আমরা ওই মার্কেটগুলো পরিদর্শনে যাব।

এদিকে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও গতকাল বঙ্গবাজার পরিদর্শনে যান।

Related posts

Leave a Comment