মিয়ানমার সেনাদের সন্ত্রাসী অভিযান: চারদিকে লাশ আর পোড়া ঘর

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

দিনটি ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। মধ্য মায়ানমারের কোনে ইওয়ারের গ্রামবাসীরা পালিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র দুই ঘণ্টা সময় পেয়েছিল। উত্তর ও পশ্চিম দিকের প্রধান রাস্তা দিয়ে সৈন্যদের একটি দল গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল। গ্রাম থেকে বের হওয়ার একটাই পথ ছিল- পূর্বদিকে একটি দুর্গম পথ এবং একটি ছোট সেতু। সেতুটি কেবল মোটরবাইক বহন করতে পারে, কোন গাড়ি ছিল না।
‘আমরা প্রায় এক হাজার লোক ছিলাম গ্রামে। সবার জন্য পালানোর একটাই রাস্তা। এটি ভীতিকর, কঠিন এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল,’ বলছিলেন ইওয়ারের বাসিন্দা কিয়াও হসান ওও।
কোনে ইওয়ার গ্রামের অধিকাংশের পেশা কৃষিকাজ। মিয়ানমারের সেনারা গ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই দূর থেকে হতাশ দৃষ্টিতে দেখছিলেন- তাদের ধানের ক্ষেতজুড়ে ধোঁয়ার বিশাল মেঘ বইতে শুরু করেছে। তাদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে সেই মেঘ।

৩০ বছর বয়সী কিয়াও হসান ওও জানান, সেনাদের অভিযানের পরদিন তিনি গ্রামে ফিরে দেখেন প্রায় ৬০০ পরিবারের গ্রামটির অধিকাংশ অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রায় ৩৮৬টি পরিবারের কাঠ ও ইটের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। সমস্ত জিনিসপত্র- জামাকাপড়, আসবাবপত্র, খাবারের পাত্র ধংসের পাশাপাশি গৃহহীন করে দিয়েছে তাদের। কেবল তাদের পরনের কাপড়টিই আস্ত রয়েছে।
এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার হলো, ফিরে আসা গ্রামবাসীরা ৫০ বছর বয়সী দু’জন ব্যক্তির মৃতদেহ দেখতে পান, যারা শারীরিকভাবে দুর্বল থাকার কারণে পালাতে পারেননি। তাদের গুলি করা হয়েছে। আরেক ব্যক্তির দগ্ধ দেহ তার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে।
কিয়াও সান ওও নামের স্থানীয় একজন বলছিলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি সমর্থনের কারণে কোনে ইওয়ার গ্রামকে টার্গেট করা হতে পারে। জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী গত নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতি করে ভিত্তিহীন ক্ষমতা দখলকে ন্যায়সঙ্গত করেছে।
এই অভ্যুত্থানের ফলে কোনে ইওয়ারসহ সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে বাসিন্দারা প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় নেমে আসে। সামরিক বাহিনী নৃশংসভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়সহ দেশের বিভিন্ন শহরে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেনাশাসন পরিবর্তন করতে না পেরে হতাশ হয়ে মিয়ানমারের জনতা সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। এ পরিস্থিতিকে ক্ষমতাচ্যুত আইনপ্রণেতাদের প্রতিষ্ঠিত ছায়া প্রশাসন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গণঅভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছে।

ক্ষমতা দখলের দুই বছরেরও বেশি সময় পর সহিংসতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৫ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী কমপক্ষে ২ হাজার ৯৪০ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে এবং ১৭ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করেছে। এমন পরিস্থিতি মিয়ানমারে মানবাধিকারের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সামরিক বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলা, আর্টিলারি গোলাবর্ষণ এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) নামে পরিচিত বেসামরিক মিলিশিয়াসহ সেনা শাসনবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সংঘর্ষ চলছেই। ফলে দেশব্যাপী ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মধ্য মায়ানমারের সাগাইং অঞ্চলের মতো সহিংসতা দেশটির আর কোথাও তীব্র হয়নি। সেখানে কোনে ইওয়ার এলাকা অবস্থিত। এসব অঞ্চলে প্রতিদিনই সংঘর্ষ, বিমান হামলা, বোমা হামলা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে।
জাতিসংঘ বলেছে, জান্তারা শুধু সাগাইংয়ে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ হত্যাকাণ্ড এবং হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করেছে, যা নথিভুক্ত করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী সাগাইংয়ে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিয়েছে এবং অ্যাডহক ভিত্তিতে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে সাংবাদিকরা এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংঘাত সম্পর্কে রিপোর্ট করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার সানাদ ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের প্রাপ্ত স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ওই এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এবং কিছু গ্রাম প্রায় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বেশ কয়েকটি গ্রামের বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা টেলিফোনে আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, সৈন্যরা পালিয়ে যেতে না পারা খুব বয়স্ক বা শারীরিক অক্ষমদেরও হত্যা করেছে। বাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করেছে, পরিচয়পত্রের মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ধ্বংস করেছে এবং ভবন ও জমা রাখা খাদ্যে আগুন দিয়েছে। জাতিসংঘ ও স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলোর মতে, আগুন লাগার ঘটনায় সাগাইংয়ে লাখ লাখ মানুষের জরুরি খাদ্য সহায়তা ও আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়েছে।
কিয়াও হসান ওও বলেন, ‘তারা (জান্তা বাহিনী) এমন সব গ্রামকে টার্গেট করছে, যারা জান্তা সরকারকে মেনে নিচ্ছে না। কোনো গ্রাম তাদের সঙ্গে একমত না হলেই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তি জান্তাদের কথা না শুনলে বা আনুগত্য না হলেই হত্যা করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) দাবি করা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আল-জাজিরা বারবার কল এবং ই-মেইলে যোগাযোগ করলেও প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) সহযোগী ফেলো শোনা লুংয়ের মতে, অভ্যুত্থান পরবর্তী সহিংসতা (বিশেষ করে যার মধ্যে সাগাইং, ম্যাগওয়ে এবং মান্দালয় অঞ্চলে) মিয়ানমারের ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনা। দেশের স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমারের বৌদ্ধ-বামার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের সশস্ত্র সংঘাত কখনও ঘটেনি।

Related posts

Leave a Comment