যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধে সরকারই চাপে আছে,  বিএনপি নই

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টারঃ

যুক্তরাষ্ট্র ভিসার বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করার বিষয়ে এককভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকেই দায়ী করছে বিএনপি। এ ঘটনাকে বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক ও লজ্জাকর মনে করলেও এর প্রভাব বিএনপির ওপর পড়বে না বলে দাবি করেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, সরকার নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মী নির্যাতন, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা রকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির ইস্যুতে গতকাল শনিবার বিএনপি নেতারা এসব কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নন বলেও জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, দেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের পেছনে সরকারই দায়ী। তার সঙ্গে এখন যারা জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে দাবি করছে, আবার সরকারের সঙ্গেও আছে, তারাও দায়ী। তাদের কারণেই এ ধরনের পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন দল ও তথাকথিত বিরোধী দলের জন্যই এটি চিন্তার বিষয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কার্যকারিতা শুরু ঘোষণার পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, প্রথম তালিকায় সরকারি দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা রয়েছেন।

বিরোধী দলের নাম থাকলেও তাতে বিএনপি নেতাদের কিছু হবে না। তারা আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থানে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলেও আওয়ামী লীগও আর যেনতেন নির্বাচনের পথে হাঁটার সাহস পাবে না। নিজের, পরিবারের ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা এবার থমকে যাবেন। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ এসেছে। এটি দেশের জন্য প্রাপ্য নয়। এ জন্য বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো দায় নেই, এককভাবে সরকারই দায়ী। বাইডেন প্রশাসন বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছে। এর আগে তারা গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে এক ধরনের বার্তা দিয়েছিল।

তিনি বলেন, পরপর দুটি সম্মেলন থেকে বাদ পড়ার পরও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সেই বার্তাকে অনুধাবন করেনি দেশের ক্ষমতাসীনরা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরও সরকার তাতে গুরুত্ব দেয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে সরকারকে বার্তা দিয়েছে। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণের জন্য বলেছে তাতেও সরকার কর্ণপাত করেনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপে বাংলাদেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কিনা– প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতি দিয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি। আসলে এখন সরকার কী করবে, সেটা তাদের ওপর নির্ভর করছে। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন।

ভিসা নীতি নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন নয়– এ বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের চেয়ারম্যান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একটু অপেক্ষা করেন। তাদের মুখ থেকেই অনেক কথা বেরিয়ে আসবে। এর আগে তারা এ রকম অনেক কথা বলেছে। কিন্তু ক্ষতিটা তো দেশের হচ্ছে। দেশের সুনাম নষ্ট হয়েছে শুধু তাদের অপকর্মের জন্য। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এবারও তারা নিজেদের শুধরে না নিলে এর পরিণাম আরও খারাপ হতে পারে। যা দেশের জনগণকেই বহন করতে হবে।

এদিকে দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির পদক্ষেপকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণায় তারা এই ভিসা নীতিকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। অনেকে কাদের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে তার সম্ভাব্য তালিকাও প্রকাশ করছেন। দলের কূটনৈতিক উইংয়ের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, তৃতীয় বিশ্বে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমর্থন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে ভিসা নীতিকে তারা সেই সমর্থক হিসেবে দেখছেন।

গত ২৪ মে বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার চার মাসের মাথায় গত শুক্রবার দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানে দায়ী ও জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিরোধী দলের সদস্যও রয়েছেন। এখানে বিরোধী হিসেবে কাদের চিহ্নিত করা হয়েছে– সেটা নিয়েও ইতোমধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টিকে বোঝানো হয়েছে। এই দলটির সঙ্গে সরকারের আঁতাত, নির্বাচনে অংশ নিতে জাল-জালিয়াতির সঙ্গেও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং, এখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করার জন্য বিরোধী দল হিসেবে ওই দলটির নেতাদের ওপর ভিসা নীতি প্রয়োগ হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরই মধ্যে ওই দলের বেশ কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে ভিসা নীতির আওতায় পড়েছেন বলেও প্রচারণা চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে বিরোধী দলের ওপর কার্যকর করার বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, ২০১৪ একতরফা ও ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতে করার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চেয়ারে বসা জাতীয় পার্টি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল বয়কট করলেও একাদশে সবাই অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সেই নির্বাচনেও বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, প্রার্থীদের ওপর হামলা, নির্যাতন আর কারাগারে নেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি কোনো সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়নি।

সরকার পতনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরিশাল বিভাগীয় রোডমার্চে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, আমেরিকার ভিসা নীতি আরোপ কার্যকর হয়েছে। এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভিসা নীতি ঘোষণা দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ রক্ষায় প্রশাসনের যারা কাজ করছেন তারাও ভিসা নীতির কবলে পড়বেন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, বাংলাদেশ ইতিহাসের বিগত ৫২ বছরে যেটা সামরিক শাসনামলেও হয়নি– সেটা এই সরকারের আমলে হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের অংশ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তাদের দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জে প্রার্থী রুমানা মাহমুদকে গুলি করা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ আরও অনেক প্রার্থীর ওপরে সরাসরি হামলা করা হয়েছে। এই নির্বাচনেও গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে রেখে আবারও দেশে বাকশাল গঠনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিরোধী দল হিসেবে সংসদীয় বিরোধী দলকেই বোঝানো হয়।

দলের কূটনৈতিক উইংয়ের সদস্য ব্যারিস্টার মীর হেলাল বলেন, বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেভাবে একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করছে, সেটার জন্যই তারা এই আন্দোলন করছেন। বর্তমানে কিংবা এরও আগে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যারা অধিষ্ঠিত ছিল, তাদেরই বুঝানো হয়েছে।

Related posts

Leave a Comment