রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলার শুনানি শুরু

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলার শুনানি আজ সোমবার আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) শুরু হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের হেগে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় সাড়ে ছয়টায় সূচনা হয় শুনানি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের দিয়েই রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা লড়ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। গত কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর নিষেধাজ্ঞার তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, মামলায় দেশটির প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত আটজনের মধ্যে অন্তত চারজনের ওপর এখনো নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে।
ইইউর নিষেধাজ্ঞায় থাকা ব্যক্তিরা কিভাবে এবার দ্য হেগে আইসিজেতে শুনানিতে অংশ নেবেন, তা-ও নিশ্চিত নয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই মামলায় প্রথম পর্বের শুনানির পর আদালত অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছিলেন। এবার শুনানি হচ্ছে আদালতের বিচারিক এখতিয়ারসহ মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তিগুলো নিয়ে।
প্রথম পর্বের শুনানিতে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অং সান সু চিকে কারাগারে নিক্ষেপের পর জুনে আইসিজের আট সদস্যের আইনি দল গঠিত হয়।
এই দলের প্রধান করা হয়েছে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উনা মং লুইনকে। ইইউ গত বছর এপ্রিলে ও যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আইনি দলের সদস্য কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কো কো হ্লাইং, পরিকল্পনা, অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী উইন শেইন এবং অ্যাটর্নি জেনারেল থিডার ওপরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর নিষেধাজ্ঞা আছে। আইনি দলের সদস্য মিয়ানমারের লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ার পায়ে, অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মিয়ো জাও থেইন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়াও মিয়ো টুট এবং আইন বিশেষজ্ঞ খিন ও হ্লাইংয়ের নাম নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
আইসিজে জানিয়েছে, কভিড পরিস্থিতির কারণে শুনানি হচ্ছে হাইব্রিড কাঠামোয়। এ ব্যবস্থায় আদালতের কিছু সদস্য আদালতে সশরীরে উপস্থিত থাকছেন। বাকিদের ভিডিও লিংকের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ার কথা। বিবদমান দুই পক্ষও সশরীরে বা ভিডিও লিংকের মাধ্যমে আদালতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
আইসিজে বলেছে, মামলা বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি নিয়েই এবার শুনানি হচ্ছে। এতে মিয়ানমার তার আপত্তির পক্ষে মৌখিকভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার সুযোগ পাবে। এক দিন বিরতি দিয়ে আগামি বুধবার সন্ধ্যায় গাম্বিয়া মামলার পক্ষে তার যুক্তি উপস্থাপন করবে। এরপর শুক্রবার রাতে মিয়ানমার এবং রবিবার রাতে
গাম্বিয়া যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে।

জান্তা ও সু চিপন্থীদের স্বীকৃতির লড়াই :
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উত্খাতের পর সরকারের আদলে ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল’ গঠন করে সামরিক কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল’কে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিলের’ নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল’ মনোনীত প্রতিনিধিকেও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করেনি জাতিসংঘ।
মিয়ানমারের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী কর্তৃপক্ষ কে—তা নিয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে জান্তা নেতৃত্বাধীন ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল’ ও অং সান সু চিপন্থী জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজে) মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই চলছে। এর মধ্যে আগামীকাল এই শুনানি শুরু হচ্ছে। এনইউজে নিজেদের মিয়ানমারের বৈধ সরকার বলে দাবি করে আইসিজেতে আবেদন করলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত আদালত তাতে আনুষ্ঠানিক সাড়া দেয়নি।
এনইউজে সম্প্রতি আইসিজেকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং এই মামলায় আইসিজের বিচারিক এখতিয়ার আছে বলে এনইউজি স্বীকার করে। তাই তারা এখতিয়ার নিয়ে শুনানিতে সময় নষ্ট না করে বিচার শুরু করার আবেদন জানিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিজেতে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগকে জান্তা তার বৈধতা হিসেবে দেখাতে পারে। আবার জাতিসংঘ জান্তাকে যেখানে স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে জাতিসংঘ গঠিত আদালতে জান্তা সরকারের প্রতিনিধিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধ তদন্তে জাতিসংঘ গঠিত সাবেক স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী কমিশনের সদস্য ক্রিস্টোফার সিডোটি গতকাল এক পডকাস্ট বার্তায় বলেছেন, জান্তা মিয়ানমারের সরকার নয়। দেশে ও বিদেশে মিয়ানমারের সরকার হিসেবে কাজ করার কর্তৃত্ব বা সামর্থ্য কোনোটিই জান্তার নেই।

মামলায় দৃষ্টি বাংলাদেশের :
মিয়ানমারের ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। আইসিজেতে গণহত্যার মামলা করা এবং মামলা পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগে গাম্বিয়ার পাশে আছে বাংলাদেশ।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, আইসিজেতে ‘না’ বলার ক্ষমতা মিয়ানমারের নেই। কারণ মিয়ানমার সংস্থাটির সদস্য। তিনি বলেন, আইসিজেতে প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যখন পুরো রায় আসবে এবং আদালত যদি বলে গণহত্যা হয়েছে, তখন কিন্তু গণহত্যাকারী সরকারের সঙ্গে অন্য দেশগুলো স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারবে না।

Related posts

Leave a Comment