অযোধ্যা: এগোচ্ছে মন্দির নির্মাণ, শুরু হয় নি মসজিদ তৈরির কাজ

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

ছয়ই ডিসেম্বর, ১৯৯২। হাজার হাজার উন্মত্ত হিন্দু ভেঙ্গে ফেলেছিল অযোধ্যার বাবরি মসজিদ।
নয়ই নভেম্বর, ২০১৯। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক ঐতিহাসিক রায়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরির রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ওই জায়গাতেই একসময়ে দাঁড়িয়ে ছিল বাবরি মসজিদ।

সর্বোচ্চ আদালত তাদের রায়ে রাম মন্দির বানানোর পক্ষে রায় দেয়ার সঙ্গেই এই নির্দেশও দিয়েছিল যে মুসলমানদের জন্য পাঁচ একর জমি দিতে হবে, যেখানে তারা একটি মসজিদ বানিয়ে নিতে পারবেন।

অযোধ্যা থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে ধন্নিপুর গ্রামে সেই জমি দেয়া হয়েছিল।

সেই গ্রামে গিয়ে খোঁজ করছিলাম যে মসজিদ তৈরির কাজ কতদূর এগোল আর কবেই বা তা সমাপ্ত হতে পারে।
গ্রামে দেখা হয়েছিল ওই জমিটির কেয়ারটেকার সোহরাব খানের সঙ্গে।

মসজিদের নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায়

“এটাই সেই পাঁচ একর,” জমিটা দেখিয়ে বললেন মি. খান।
মুসলমান সম্প্রদায়কে দেওয়া পাঁচ একর জমির কেয়ারটেকার সোহরাব খান
তার কথায়, “এটা একটা ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে। ভবনটির নকশার জন্যই নির্মাণ আটকে আছে। নকশাটা উন্নয়ন পরিষদের কাছে জমা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কয়েকটা দপ্তর থেকে ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো পাওয়া যাবে।”
খাতায় কলমে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে ওই জমিতে মসজিদ ছাড়াও থাকবে একটা হাসপাতাল, সংগ্রহশালা আর একটা পরিষেবা ব্লক। হাসপাতালটি ২০০ শয্যার হবে আর মসজিদে একসঙ্গে ২০০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারবেন।
যে মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহের নামাঙ্কিত সংগ্রহশালাটি তৈরি করা হবে, তার মূল ভাবনায় থাকবে ১৮৫৭ মহাবিদ্রোহ।

এখন ওই জমিতে আগে থেকে তৈরি হওয়া একটি মসজিদ রয়েছে।

ধন্নিপুরের সেই ৫ একর জমি, যা সুপ্রিম কোর্ট মুসলমান সম্প্রদায়কে দিয়েছে
ভবনগুলির নকশা তৈরি করে অযোধ্যা উন্নয়ন অথরিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু করোনার কারণে গোড়ার দিকে সমস্যা হচ্ছিল। পরে কর্মকর্তারা জানান যে একটা নো অবজেকশান সার্টিফিকেট বা ছাড়পত্র লাগবে। দমকল বিভাগ থেকেও ছাড়পত্র আনতে হবে।
এখানেই একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। পাঁচ একর জমিতে পৌঁছনোর রাস্তাটা মাত্র চার মিটার চওড়া। সেটাকে আরও চওড়া করতে হবে। এখন সেই কাজ চলছে।

ধন্নিপুর প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে হচ্ছে

পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য “ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন মসজিদ ট্রাস্ট”এর কাছে এখনও পর্যন্ত ৩৫ লক্ষ টাকা জমা পড়েছে।
স্থানীয় মানুষরা বলছিলেন, এখনও পর্যন্ত কিছু মুসলমান ব্যক্তিগত ভাবেই অর্থ দিচ্ছেন। বড় অঙ্কের কোনও ক্রাউড ফান্ডিং এখনও করা যায় নি।
মাস দুয়েক আগে ফারুখাবাদে অর্থ যোগাড় করার একটা অভিযান চালানো হয়েছিল, যেখান থেকে ১০ লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছিল।

পরিকল্পিত মসজিদ কমপ্লেক্সটি যেমন দেখতে হবে
মসজিদ ট্রাস্ট জানাচ্ছে, সব ধরণের ছাড়পত্র পাওয়ার পরে পুরো দেশ থেকে অর্থ যোগাড়ের অভিযান চালানো হবে।
ধন্নিপুর প্রকল্প দুটি ধাপে নির্মিত হবে, যার জন্য প্রাথমিক ভাবে ৩০০ কোটি টাকা লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রথম ধাপে মসজিদ, হাসপাতালের একটি অংশ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর বিশ্ব উষ্ণায়নের কথা মাথায় রেখে একটা “গ্রিন বেল্ট” তৈরি করা হবে। দ্বিতীয় ধাপে শুধুই হাসপাতালের সম্প্রসারণ করা হবে, যার জন্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
ট্রাস্টের আশা যে সরকারি ছাড়পত্র পাওয়ার পর থেকে দু’বছরের মধ্যে প্রথম ধাপের নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে। ওই হাসপাতালে নারী আর শিশুদের অপুষ্টি থেকে যেসব রোগব্যাধি হয়, তার চিকিৎসা করা হবে।

ট্

রাস্টের সচিব আতাহার হুসেইন
ট্রাস্টের সচিব আতাহার হুসেইন আশা করছেন, “আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে সব অনুমতি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে। তার পরে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যাবে।”

মসজিদ চত্বরে সংগ্রহশালা

সংগ্রহশালাটি এই গোটা পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে।
ট্রাস্ট মনে করে যে রাম মন্দির আন্দোলন আর তার সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলির ফলে সমাজের মধ্যে একটা আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ, যাকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়ে থাকে, সেখানে কিন্তু হিন্দু-মুসলমান একজোট হয়েই লড়াই করেছিল। সেই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল বর্তমানের অযোধ্যা, যা তখন আওয়াধের।
সেই ইতিহাসই মানুষের সামনে তুলে ধরতে চায় ট্রাস্ট।
সংগ্রহশালার নামকরণও মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহের নামে করা হচ্ছে, যিনি আওয়াধের একজন মৌলবি হলেও ১৮৫৭-তে লক্ষ্ণৌয়ের যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল।
মসজিদের নির্মাণকাজে যেসব সমস্যা আসছে, সেগুলো আরও ভাল করে বোঝার জন্য আমি লক্ষ্ণৌতে ইন্দো-ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন মসজিদ ট্রাস্টের দপ্তরে গিয়েছিলাম।

রামমন্দির নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, ধন্নিপুর প্রকল্প নিয়ে তা একেবারেই নেই: আতাহার হুসেইন
ট্রাস্টের সচিব আতাহার হুসেইন বলছিলেন, “প্রথমেই একটা কথা পরিষ্কার করে দিই যে রাম মন্দির আর আমাদের যে পাঁচ একর জমি দেয়া হয়েছে, সেটার তুলনা করা অযৌক্তিক। আর তুলনা করার দরকারটাই বা কি? রাম মন্দিরের পরিকল্পনা অনেক দিনের, তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি চলেছে। অন্যদিকে আমরা তো ২০১৯ সালের নভেম্বরে জানতে পারলাম যে এই পাঁচ একর জমি আমাদের দেওয়া হচ্ছে।”
“রাম মন্দির নির্মাণের জন্য যে প্রচার অভিযান চলেছে, বা তা নিয়ে যে উন্মাদনা ছিল, সেটা তো এখানে একদমই নেই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এখানে একটা ভাল হাসপাতাল তৈরি করা। তবে মসজিদের জন্য জমি দেয়া হয়েছে, তাই সেটা তো নির্মাণ করতেই হবে,” বলছিলেন মি. হুসেইন।
ওদিকে ধন্নিপুরে কেয়ারটেকার সোহরাব খানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সেখানেও কি অযোধ্যার মতোই একটা ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্র গড়ে উঠবে?
তার জবাবটা ছিল, “অনেকেই এই প্রশ্নটা করেন এখানে এসে। সংবাদমাধ্যমের কর্মী হোক বা স্থানীয় মানুষ – অনেকেরই এটাই জিজ্ঞাস্য থাকে যে সরকার এখানে উন্নয়নের জন্য কী করছে? অযোধ্যা শহরে উন্নয়নের যে বন্যা বইছে, সেই নদীর একটা ছোট ধারাও এখানে পৌঁছায় নি।”
অযোধ্যায় যেরকম লাখো মানুষ আসেন, ধন্নিপুরে মাঝে মাঝে কেউ আসেন খোঁজখবর নিতে বা এমনিই দেখতেও আসেন কেউ কেউ।
ধন্নিপুরের বাসিন্দা আশারাম যাদব বলছিলেন, “এখানে একটা ভাল কাজ হচ্ছে – হাসপাতাল হবে, মসজিদ হবে, তাতে তো গ্রামেরই উন্নয়ন হবে। বাইরে থেকে মানুষ আসবেন। আমাদের এসব নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। হাসপাতাল বা লাইব্রেরি হলে তা নিয়ে কেন কারও কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে।”

বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির মামলার অন্যতম মামলাকারী ইকবাল আনসারী
অযোধ্যার ছোটি কোঠিয়া এলাকায় থাকেন রামমন্দির-বাবরি মসজিদ মামলার অন্যতম আবেদনকারী ইকবাল আনসারী।
তার কথায়, “মামলা লড়ে পাঁচ একর জমি পাওয়া গেছে, কিন্তু ওই জমির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। জমিটা সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়া হয়েছে। তাদের যা মনে হয় বানাক তারা সেখানে। অযোধ্যার মুসলমানরা আদালতে মামলা লড়েছে, যা রায় হয়েছে, সেটাই আমরা মেনে নিয়েছি। ওই বিষয়ের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক আমাদের নেই। যারা মসজিদ বানাচ্ছে, তারা বানাক।”
মি. আনসারীর প্রতিবেশী শফিকুল্লাহ একটা দোকান চালান।
তিনি বলছিলেন, “শুনেছি জমি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কখনও যাই নি সেখানে। ঠিক কোন জায়গায়, সেটাও জানি না। জমিটা কীরকম তাও খোঁজ নিই নি। শুনেছি তো ওখানে এখনও কিছুই হয় নি।”
পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ২৫-বছর বয়সী পারভেজ আলম।
“ধন্নিপুরের নাম সংবাদে শুনেছি। সেখানে মসজিদের জন্য জমি দেয়া হয়েছে, এটাও ওই খবরেই জেনেছি।”

রাম মন্দির নির্মাণের কাজ কীভাবে চলছে?

রাম মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে
দু’হাজার একুশ সালের জানুয়ারিতে মন্দির নির্মাণের জন্য খনন কাজ শুরু হয়। আর ধাপে ধাপে নির্মাণের শেষে ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে মন্দিরের চূড়া আর ছাদের কাজ শেষ করা হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্র রাম মন্দিরের আর্কিটেক্ট চন্দ্রকান্ত সোমপুরাকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, মন্দিরের উচ্চতা ১৪১ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৬১ ফুট করা হয়েছে। তিনটে নতুন চূড়াও যোগ করা হচ্ছে এবং থামের সংখ্যা ১৬০টি থেকে বাড়িয়ে ৩৬৬ করা হয়েছে।

রাম মন্দির নির্মাণে কত খরচ হবে?

‘শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র’-র মহাসচিব চম্পত রায়ের কথায়, “ভগবানের ঘর বা রাজা-মহারাজাদের ঘর বানাতে কত খরচ হবে তা কি কেউ বলতে পারে? আর উনি (শ্রী রামচন্দ্র) তো ভগবানেরও ভগবান। তাই খরচের ব্যাপারে নজর দেয়া আমরা ছেড়ে দিয়েছি। তাও ১৮০০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে ধরে নেয়া যেতে পারে। কিছুটা কম বেশিও হতে পারে।”

রাম মন্দির নির্মাণে কত খরচ হবে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা
“ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজে তো কোন শতকরা হিসাব পাওয়া যায় না, তবে মোট কাজের প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। পাথরের খোদাই করার কাজ শেষ, এখন সেগুলো বসানোর কাজ বাকি আছে,” বলছিলেন মি. রায়।
তিনি জানাচ্ছিলেন, “তেলেঙ্গানা আর কর্ণাটক থেকে ১৭,০০০ গ্রেনাইট পাথর আসছে। একেকটা পাথর পাঁচ ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া আর তিন ফুট উঁচু। গ্রানাইট দিয়ে বসার জায়গা তৈরি হবে। এছাড়া মন্দিরের বাকি পাথর আসছে রাজস্থানের ভরতপুর থেকে। হাল্কা গোলাপি রঙের সেই পাথরগুলো বেলে পাথর। আর মকরানার সাদা মার্বেল পাথরও আসবে।”-বিবিসি

Related posts

Leave a Comment