কবর জিয়ারত

-কাজী মোঃ হাসান

যাওয়ার আগের দিন আম্মু স্থানীয় কবরস্থানে গেলেন মামার কবর জিয়ারত করতে। এখানে দীর্ঘ তিন বৎসর যাবৎ শুয়ে আছেন রঞ্জুর একমাত্র মামা। মামার মৃত্যু, সে এক করুণ কাহিনী। এই ঘটনাটা শুধু রঞ্জুকেই নয়- বাড়ির সব্বাইকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে যায়, দুঃখ দেয়, কাঁদায়।
একমাত্র সন্তান রঞ্জুর নানু। খুব বড় লোক না হলেও জমিজমা মন্দ ছিলো না। হেসে খেলেই চলে যেতো তাঁদের সংসার।
আশ্চর্যের ব্যাপার, রঞ্জুর মামাও চার বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই। আম্মু এবং মামা ছিলেন পিটাপিঠি। তবে মামাই বড়। লেখাপড়া করতেন একই স্কুলে। সারা বৎসর দু’জনে একসঙ্গে ছয় মাইল হেটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। উভয়ের মধ্যে মারামারিটাও ছিলো সাপে নেউলের মতো। মিলটাও ঠিক তেমনি। কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতেন না।
নিম্ন প্রাইমারীতে বৃত্তি পেলেন আম্মু। সে থেকেই বিপত্তিটা শুরু। বৃত্তি পাওয়ার কারণে আম্মুর নামটা ছড়িয়ে পড়ে সবার মুখে মুখে। অনেকেই আর্শিবাদ জানাতে আসেন তাঁকে। এর রেশ ধরেই শুরু হয় বিয়ের প্রস্তাব আসা। একটা প্রস্তাবে না করেন তো আর একটা খাড়া।
‘মেয়েদের এতো বেশী পড়ালেখা করিয়ে কী লাভ! তার চেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়াই ভালো’- মুরুব্বিদের এমন চিন্তাধারায় প্রভাবিত হলেন নানু। তাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসার করতে পাঠালেন।
এখন তো রাস্তা-ঘাট, গাড়ী-ঘোড়ার কোন অভাব নেই। তখন এতো কিছু ছিলো না। যানবাহন বলতে লঞ্চ, নৌকা, ট্রেন অথবা ছোট ছোট বাস। লোকে শখ করে এসব বাসের নাম দিয়েছিলো- মুড়ির টিন। তবে বেশী ভাগ ক্ষেত্রে পায়ে হাটাই ছিলো ভরসা। তাই আট-দশ মাইল যেতেই দিন কাবার।
আম্মুর বিয়ে হলো বাড়ি থেকে আনের দূরে। তখনকার দিনে প্রায় এক দিনের পথ। এক জেলা থেকে আরেক জেলা। দূরত্ব যা-ই হোক, বোনকে দেখার ইচ্ছে হলেই যখন তখন চলে আসতেন মামা। বাড়ি থেকে ছয়-সাত মাইল হাটার পর ঢাকা যাওয়ার লঞ্চ। লঞ্চে পুরু একদিন চলার পর বারদির হাটে নেমে আবার হাটা। বোনের জন্য এই দূরত্বটাও মামার কাছে মামুলি ব্যাপার।
বিয়ের দেড় বৎসর পরের ঘটনা। একদিন কাউকে কিছু না বলে এক বন্ধুকে নিয়ে বোনকে দেখতে চলে এলেন মামা। তাকে দেখে আম্মু তো অবাক-
: আরে ভাইয়া! তুমি? বাড়ির সবাই ভালো তো?
: ভালো।
: তা হলে আবার এলে কেন? একমাসও তো হলো না, তুমি গেলে।
: তাতে কী হয়েছে! ভাই বোনকে দেখতে আসবে, তার আবার সময় অসময় কী রে!
বোনের কথার জবাব দিতে গিয়ে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লেন মামা। আম্মু জানেন, মামা এ রকমই। তাকে কিছু বলে কোন লাভ নেই। যখন যা বুঝেন তাই করে বেড়ান অবলীলায়। লোকে বলে- এক ছেলে বলেই মামার নাকি ‘মল্লির’(রগচটা) দোষ আছে। হবে হয়তো!
আম্মু আর কিছু বললেন না। মামাকে নিয়ে ঘরে গেলেন। দাদু, দাদী, জেঠাজী এরাও তাকে স্বাগত জানালেন আন্তরিক ভাবেই। কারণ, সবাই জানেন- এই দু’জনে মধ্যে সম্পর্কটা কত মধুর।
তা ছাড়া, তাদের বয়সই বা কতো? এখনো দুই ভাই-বোন একত্র হলে ঝগড়া-ঝাটি, কিলাকিলি, হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। এ ছাড়া নানা রকমের দুষ্টুমি তো আছেই! অনেক সময় তাদের ঝগড়া-ঝাটির পর মান ভাঙ্গাতে রঞ্জুর দাদা-দাদীকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়।
হাত মুখ ধুয়ে মামা ও তার বন্ধু সবার সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্রাম করতে গেলেন বাংলো ঘরে। আম্মু সংসারের সব কাজ গুছিয়ে এক সময় মামার কাছে গিয়ে ভাইয়ের কপালে হাত রেখে বললেন-
: আচ্ছা ভাইয়া, তুমি সত্যি করে বলতো, বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
: একশ ভাগ ভালো! আমি তোর সঙ্গে মিথ্যে বলছি নাকি?
তবু আম্মু বিশ্বাস করতে চান না! এই তো এক মাসও হলো না, তিনি এখান থেকে গেছেন। আবার এমন কী হলো যে, কোন কারণ ছাড়াই এতো তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন? না, এই আসাটা কিছুতেই মানতে পারছেন না আম্মু। ভাবতেই কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে, অস্বস্থিতে খচ কচ করছে মনের ভেতর । শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা কী ভাববে- কে জানে?
আম্মু মামার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তার পর জিজ্ঞেস করলেন-
: আচ্ছা ভাইয়া, ধরে নিলাম তুমি আমাকে দেখতে এসেছো। কিন্তু তোমার ভালো জামাকাপড় কই? কিছুই তো আনোনি! পড়বে কী? তুমি কি ঝগড়া করে বাড়ি থেকে এসেছো?
: দূর বোকা! ঝগড়া করবো কোন দুঃখে? কার সঙ্গেই বা করবো? তুই থাকলে না হয় কথা ছিলো। তা ছাড়া কাপড়-চোপড় এনে কী হবে? এগুলো পড়বে কে ? আমি কী সারা জীবন এখানে থাকবো না-কি? আনলে আবার নিতে হবে। কে নেবে সেগুলো?
: কি যে বলো না ভাইয়া! তুমি যখন বাড়ি ফিরে যাবে তখন নিয়ে যাবে!
: থাক, থাক। এ নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না। একভাবে না একভাবে দিন চলেই যাবে। মিছামিছি দুশ্চিন্তা করিস না তো!
মামা এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। অন্য কথা তুললেন।
দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেলো। ছষ্ঠ দিন মামা গোসল করার সময় কাকার সঙ্গে নদীতে পাঞ্জার পাশে পেতে রাখা নৌকা তুলে মাছ ধরতে গেলেন।
অনেক মাছ ধরা পড়লো নৌকায় থেকে। এতো মাছ ধরতে পেরে মামা ভীষণ খুশী।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সবার কাছে বিদায় চাইলেন মামা। কিন্তু আম্মু কিছুতেই মামাকে ছাড়তে নারাজ। আবদার ধরলেন-
: ভাইয়া, আর একটা দিন থেকে যাও।
: না-রে, আর না, অনেক দিন তো হলো!
: তা হোক, আর একটা দিন থাকলে এমন কোন অসুবিধা হবে না।
আম্মু গিয়ে মামার কাপড় চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন। অন্যান্যরাও বাঁধা দিলেন যেতে। কিন্তু তিনি থাকলেন না।
আসলে, মামাকে বুঝানো কারো সাধ্য নয়। যখন যা ভাবেন, তাই করেন- এটা তো জানা কথা! তবু যতটুক সম্ভব সবাই মামাকে বুঝালেন। কিন্তু কোন কথাতেই কাজ হলো না। বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন বন্ধুর সঙ্গে।
মেঘনার ঘাটেই লঞ্চ থামে। সে ঘাটেই মামা বন্ধুকে নিয়ে লঞ্চের অপেক্ষায় বসে রইলেন কয়েক ঘন্টা। এই এলো, এই এলো- বলতে বলতে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেছে সেই কবে। আসলে, লঞ্চ যে কখন আসবে তা একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন! দেরি হতে হতে প্রায় বিকেল। তারপরও লঞ্চের দেখা নেই!
হঠাৎ ডায়রিয়া দেখা দিলো মামার। শেষটায় অবস্থাটা এতোটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলো যে বিকেল পাঁচটার দিকে লঞ্চ এলেও তিনি তাতে উঠতে পারলেন না। বন্ধুকে নিয়ে বোনের বাড়িতে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। কিন্তু লজ্জায় বাড়িতে ঢুকতে সাহস পেলেন না। কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকলো তার কাছে। শুধু নিজেই না, বন্ধুকেও ঢুকতে দিলেন না। তাঁর মাথায় একটাই চিন্তা- ফিরে আসার কারণটা কী বলবেন? হয়তো অনেকে এটাকে বোনের বাড়িতে থাকার অজুহাত হিসাবে ভাববে!
তাই বন্ধুকে নিয়ে রঞ্জুদের ছাড়াবাড়িতেই(বাহির বাড়িতেই) বসে রইলেন সারাটা বিকেল। সব চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, সময়টা বিকেল বলে বাড়ি থেকে ছাড়াবাড়িতে কারো যাওয়া হয়নি। ফলে তাঁরা নজরেই আসেনি কারোর।
এদিকে অবস্থা খারাপ হতে হতে এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন মামা। উপায় না দেখে মামার বন্ধু খবর দিলেন বাড়িতে। ছুটে গেলেন সবাই। ধরাধরি করে মামাকে নিয়ে আসা হলো বাড়িতে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সময় মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় সব কিছু তখন আয়ত্বের বাইরে।
এ ছাড়া, তাৎক্ষনিকভাবে ডাক্তার, কবিরাজ বা চিকিৎসক হিসেবে কাউকেই পাওয়া গেলো না। দাদুও বাড়িতে নেই। তাঁর খোঁজে লোক পাঠানো হলো। তারা এ-গাও সে-গাও ঘুরে পেরেশান। কোথাও দাদুর দেখা নেই ।
যখন দাদু ফিরলেন তখন বাড়িতে কান্নার রোল। মামা সবাইকে ছেড়ে পরপারের যাত্রী। বলতে গেলে, বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেলেন মামা।
দূরত্বের জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মামার মৃত্যু সংবাদটা নানুদের বাড়িতে পৌঁছানো গেলো না। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। টেলিফোনগুলো ছিলো বড়লেকদের দখলে। টেলিগ্রাম সুবিধাও বড় বড় শহরে সীমাবন্ধ।
অনেকটা অনন্যোপায় হয়েই নানু বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় মামাকে। ফলে নানু-নানী, খালা-খালু এবং আত্মীয়-স্বজনেরা শেষবারের মতো তাদের প্রিয় মানুষটির মুখটাও দেখতে পারলেন না।
চারদিন পর মামার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে তার বন্ধুর সঙ্গে নানুর বাড়িতে হাজির হলেন দাদু। সংবাদটা হজম করা এই পরিবারের জন্য ছিলো খুব কঠিন। তাই যা হবার তাই হলো। মামার মৃত্যু সংবাদ শুনার সাথে সাথে জ্ঞান হারালেন নানু। রাতের দিকে জ্ঞান ফিরলেও আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারেননি। মাস কয়েক পর তিনিও মামার পথ ধরলেন।
একের পর এক বিয়োগান্তক ঘটনায় আম্মু হতভম্ব। কিছুতেই মানতে পারলেন না এসব। কেবলই মনে হতে থাকে- এই দূরদেশে বিয়ে হয়েছে বলেই মামার এই করুণ পরিণতি, নানুর হঠাৎ চলে যাওয়া!
প্রথম দিকে আম্মুর তো পাগল হওয়ার অবস্থা। সুযোগ পেলেই যখন তখন ছুটে যেতেন ভাইয়ের কবরের পাশে। মহান আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন অবুঝ শিশুর মতো।
আজ সেই ভাইয়ের কবরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন আম্মু। সঙ্গে রঞ্জুর দাদী, চাচী এবং ফুফুরা সবাই। এদিকে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অনেকটাই হেলে পড়েছে। রক্তিম হয়ে উঠছে আকাশের রঙ।
কবর জিয়ারতের সময় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের পর আম্মু আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে স্তব্দ হয়ে রইলেন, যেন পাথর। কোন কথা নেই তাঁর মুখে। একটু একটু করে স্তব্দতা এসে গ্রাস করে সমস্ত পরিবেশটা।
কবরের পাশে হঠাৎ বসে পড়লেন তিনি। চোখ বন্ধ করে কবরের উপর এমন ভাবে হাত রাখলেন যেন ভাইয়ের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন। নিজের সবটুক উপলব্দি দিয়ে অনুভব করছেন ভাইয়ের এই উপস্থিতির ছবি। এ সময় তাঁর গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো ফোঁটা ফোঁট অশ্রু ।
(“রঞ্জুর ছেলেবেলা”- থেকে)

Related posts

Leave a Comment