কুস্তি খেলা

-কাজী মোঃ হাসান

সাত সকালেই রিন্টু এসে খবর দিয়ে গেলো আজ রাতে লতিফ পোদ্দারের বাড়ির উঠানে কুস্তি খেলা হবে। ফাইনাল খেলা। হাজির টেকের সঙ্গে মধ্য পাড়ার। রাত আটটায় শুরু হবে। বর্ষায় রাস্তা-ঘাট ডুবে যাওয়ায় ইদানিং সব খেলাই ঐ উঠোনে হচেছ। উঠোনটাও বেশ বড়। অনেক মানুষ ধরে। তবে ফাইনাল বলে আজ কতটা মানুষ ধরবে- সে আল্লাই জানেন!
কিন্তু রঞ্জুর ভাবনা অন্য জায়গায়। সে খেলা দেখতে পারবে তো? লেখাপড়া ফেলে রাতের বেলা কিছুতেই দাদু খেলা দেখতে দেবেন না। দাদু কেন, অন্য কেউ-ই এ ব্যাপারে ছাড় দেবে না তাকে। জেঠাজী পর্যন্ত না। এখানে দাদীর ভুমিকা উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। দাদা যা বলেন তিনি তাতেই মাথা নাড়েন। সুতরাং রঞ্জুর খেলা দেখার আশা একশ ভাগই মেঘাচ্ছন্ন।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রোজকার অভ্যাস মতো রঞ্জু ঘুমুতে গেলো। কিন্তু চোখে ঘুম এলে তো ঘুমুবে? ঘুমের পরিবর্তে রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় জট পাকাচ্ছে। সারাক্ষণ চিন্তা করেও খেলা দেখার ফন্দিটা বের করা যাচ্ছেনা কিছুতেই।
আচ্ছা, মিথ্যা বলে অথবা পালিয়ে গেলে কেমন হয়? হ্যাঁ, এভাবে যাওয়া যায়, তবে বাড়ি ফেরার পর দাদু যখন সামনে এসে দাঁড়বেন তখন রঞ্জু কি বলবে? কিচ্ছু বলার থাকবে না। উল্টো হ্যান্ডকাপ পরা আসামীর মতো নান্তানাবুদ অবস্থা হবে তার!
কাজেই, এই চিন্তাটাও বাদ। এ ভাবে ভেবে ভেবে যত পথ বের করছে সবগুলোই নাকচ হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা। কিছুতেই যেন আসল পথটা খুঁজে পাওয়া যচ্ছে না।
তা হলে যাওয়ার পথ কী? না, নেই। কোন পথই খোলা নেই। সব পথেই যেন খিল এটে বন্ধ করে দিয়েছে কেউ। বিরক্তিতে রঞ্জু বালিশটা ছূড়ে ফেলে উঠে বসলো বিছানায়।
একটু দূরেই পাট দিয়ে শিকা তেরী করছিলেন দাদী। রঞ্জুকে উঠতে দেখে চোখ সড়িয়ে নিলেন সেদিকে। কিন্তু কিছু বালার আগেই রঞ্জু লক্ষী ছেলের মতো আবার শুয়ে পড়লো বালিশে মাথা গুঁজে। শুয়ে শুয়ে একনাগাড়ে আল্লাহ্কে ডাকতে লাগলো –
: ইয়া আল্লাহ! আমাকে অন্ততঃ একটা পথ বাতলে দাও, যাতে খেলাটা দেখতে পারি!
এদিকে হাতেও সময় নেই। নইলে বন্ধুদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে একটা বুদ্ধি ঠিকই বের করা যেতো।
রঞ্জু ভেবেই পায় না কী ভাবে যে কী করবে? ভাবতে ভাবতে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে কেবল ওপাশ ওপাশ করে।
হটাৎ একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে গেলো মাথার মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে সোজা বই নিয়ে বসে পড়লো খাটের উপর। জোরে জোরে পড়তে শুরু করে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে। তার এই অসময়ে পড়ায় মনোযোগী হতে দেখে দাদী জিজ্ঞেস করলেন-
: কী রে রঞ্জু, কী করছিস? ঘুমুচ্ছিস না কেন?
: আমি পড়ছি দাদী।
: সে তো শুনছি। কিন্তু এখন কেন? রাতে কী করবি?
: ঘুম কিছুতেই আসছে না। তাই রাতের পড়াটা এখনই শেষ করে ফেলছি।
পড়ালেখার প্রতি রঞ্জুর এই অতি আগ্রহ দেখে দাদী একটু আশ্চর্যই হলেন। ভাবলেনও একটু। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই মুচকি হেসে বিষয়টা রঞ্জুর মুখ থেকে শুনার জন্য আরও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ধুমাধুম পড়ালেখা শেষ করে রঞ্জু শুয়ে পড়লো লক্ষী ছেলের মতো। ঘন্টা একের মতো ঘুমিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলো দাদীর কাছে। কিন্তু দাদী তাকে দেখেও যেন না দেখার ভান করলেন। ভীষণ রাগ হলো রঞ্জুর। তা সত্ত্বেও মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা চালালো সে। কেননা ঠেকাটা তো তারই, নাকি?
আস্তে আস্তে দাদীর একদম কাছে ঘেষে এক ফাঁকে তাঁর গলা জড়িয়ে আব্দারের ভঙ্গীতে মনের কথাটা বলেই ফেললো এভাবে-
: তুমি তো দেখেছো, আমি কিন্তু রাতের পড়া শেষ করে ফেলেছি। ইচ্ছে হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
: তা না হয় বুঝলাম। এবার আসল মতলবটা বল? দাদী রঞ্জুর আদর-সোহাগে না ভুলে নিজের কাজে মনযোগী রইলেন আগের মতোই।
বিষয়টা একদম সহ্য হলো না রঞ্জুর। তাই দাদীর গলাটা আরও চেপে ধরে কাজে বাধার সৃষ্টি করতে লাগলো যতটা সম্ভব। এক সময় অবস্থাটা এমন হলো যে কাজ ফেলে রঞ্জুকে কাছে টেনে আদর করতে বাধ্য হলেন তিনি-
: বল, কী বলবি?
: দাদী, আজ রাতে না লতিফ পোদ্দারের বাড়ির উঠানে কুস্তি খেলা হবে। সবাই যাবে- রিন্ট,ু বাবুল, আলম, জগলুল- সবাই যাবে। আমি না গেলে আমার ইজ্জত কী থাকে- তুমিই বলো?
খেলার কথাটা দাদী আগে থেকেই জানতেন। তবু রঞ্জুর কথা শুনে দাদী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কপালে কৃত্রিম চিন্তর রেখা ফুটিয়ে এমন ভাব দেখালেন যেন- তিনি নিরুপায়। এ ব্যাপারে তার কোন হাতই নেই। তবে রঞ্জুর যুক্তিটা মানছেন-
: ঠিকই বলেছিস! যেতে না পারলে তোর ইজ্জত একদম থাকে না। কিন্তু আমি কী করবো? তোর দাদু রাজি না হলে আমি যেতে দেই কী ভাবে?
: তা হলে তুমি দাদুকে বলে পারমিশনটা নিয়ে দাও।
দাদী আপত্তি করলেন-
: না রে, আমি এ সব পারবো না। তোর দাদুকে তুই-ই বল।
: আমি বলতে পারবো না। তুমিই বলো। রঞ্জু নাছোড় বান্দার মতো আকড়ে ধরে দাদীকে। কিন্তু দাদী তাঁর কথাতে অনড়।
: না, তুই-ই বল। দেখি কী হয়!
: হয়-টয় বুঝিনা, তুমিই যাওয়ার অনুমতিটা নিয়ে দাও। পড়ালেখা তো আমি শেষ করেছি, নাকি? দাদীর কোলে বসেই হাত পা ছুড়তে লাগলো রঞ্জু।
এবার দাদী হাসতে হাসতে তাকে আশ্বস্ত করলেন-
– আচ্ছা, তুই যা! দেখি আমি কী করতে পারি।
দাদীর কাছে অনুমতি নিয়ে মাগরিব শেষ হতে না হতেই রঞ্জুরা দল বেধে লতিফ পোদ্দারের বাড়িতে গিয়ে হাজির। গিয়ে দেখে ইতিমধ্যে অনেকেই এসে গেছে। প্রথমে ওরা গিয়ে বসলো একদম সামনে- থল্লার লাইন ঘেষে। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালো।
খেলার সময় খেলতে খেলতে প্লে¬য়াররা যে ভাবে দর্শকদের উপর এসে পড়েন, ভাগ্য ভালো হলে রক্ষা- নয়তো পায়ের চাপায় নির্ঘাত ভর্তা। রঞ্জুরা এ চাপ সইতে পারবে না।
সবদিক বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত রঞ্জুরা সবাই লতিফ পোদ্দরের ঘরের পিঁড়ার উপর গিয়ে বসলো। জায়গাটা বেশ স্ন্দুর। বসার সুবিধা তো আছেই, তার উপর পেছনের বেড়ায় হেলান দিয়ে আরাম করার সুবিধাটা ফাউ।
রঞ্জুরা ধরেই নিয়েছে- মধ্যপাড়ার সঙ্গে হাজিরটেকের দল পারবে না। কারণ, মধ্যপাড়ার দলে আছে- বিল্লাল, রাজা মিয়া, সামসু, রহিমের মতো সেরা কুস্তিগীররা। বিশেষ করে রাজা মিয়া ইতিমধ্যেই সেরা খেলোয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তবে হাজির টেকের মিঠাই খাওরা, টিক্কা শেখ, টেরা মিজানও কিন্তু কম না! মিঠাইখাওরার গোঁফ দেখলেই ভয় লাগে রঞ্জুর। বাপরে বাপ! কত বড় গোঁফ। তার দুই গালই প্রায় ঢেকে আছে গোঁফ দিয়ে।
আস্তে আস্তে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো উঠোন। তিল ধারণের ঠাঁই নেই কোথাও। একদম ঠাসাঠাসি। বাড়ির আনাচ-কানাচেও লোকে গিজগিজ করছে। জায়গা নিয়ে ইতিমধ্যেই এক দফা ধাক্কধাক্কি হয়ে গেছে। বল্লানটিয়ারদের তুড়িৎ তৎপড়তায় এখন পর্যন্ত সব শান্ত।
নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগেই রেফারি রঙ্গু মিয়া মাঠে নেমে প্রস্তুতিমূলক বাঁশি বাজালেন। ইতিমধ্যে কষে মালকোচা দিয়ে, কোমরে গামছা পেঁচিয়ে দু’পক্ষের অনেক প্লে¬য়ারই নেমে গেছেন মাঠে। হাফপেন্ট পড়াও আছে কয়েকজন। হাততালি ও জিগির তুলে সবাই স্বাগত জানালো তাদের।
পরস্পর হাত মেলাবার পর শুরু হলো খেলা। প্রথম ডু দিলো হাজির টেকের টেরা মিজান। মধ্যপাড়ার কেউ তাকে মোকাবেলা করলো না। নিজের থল্লায় ফিরে গেলো সে। এবার ডু দিলো মধ্যপাড়ার সামসু মিয়া। উঠে দাঁড়ালো হাজির টেকের ভুলু। শুরু হলো কুস্তি। এটাই প্রথম বাইট। সামসু মিয়া সামান্য চেষ্টাতেই ধরাশায়ী করে দিলো ভুলুকে। সামসুর সাফল্যকে তালি দিয়ে স্বাগত জানালো সব্বাই।
পাল্টাপাল্টি খেলা এবং চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এক ঘন্টা সময় কখন যে পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারলো না কেউ। খেলা প্রায় শেষের দিকে। ইতিমধ্যেই জয়ের পাল্লা ঝুঁকে পড়েছে মধ্যপাড়ার দিকে। এই সময় অনেকটা সখ করেই ডু দিলো রাজা। সবাই জানে, সহজে কেউ তাকে মোকাবেলা করে না। তাই প্রায় সময়ই বিনা লড়াইয়ে গর্বিত পদক্ষেপে নিজের থল্লায় ফিরে আসতে হয় তাকে।
কিন্ত আজ রাজা ডু দেয়ার সাথে সাথে ডু-ডু-ডু বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো হালকা পাতলা মুন্সি মিয়া। নিজের উরুতে থাপ্পর দিয়ে রাজাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাতের কব্জি ঘুরিয়ে কয়েকবার উঠ-বস করলো কুস্তিগীর গামার মতো। ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক ভেবে হই হই করে উঠলো দর্শকরা। কে যেন ঠাট্টা করে বলেই ফেললো-
: অই, গেলি!
শব্দটার শুনার সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল পড়লো চারদিকে। কিন্তু মুন্সি মিয়া তার চ্যালেঞ্জে অনড়। যে যাই বলুক, সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ- রাজাকে আজ বিনা লড়াইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না সে। শেষ পর্যন্ত রেফারী লড়াইয়ের বাঁশি বাজাতে বাধ্য হলেন। লড়াই শুরু হয়ে গেলো। সবাই কৗতুহলী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ফলাফলের জন্য।
সবাই ভেবেছিলো এক মিনিটেই ফয়সালা হয়ে যাবে। কিন্তু এক, দুই করে সাত-আট মিনিট পেরিয়ে গেলেও ফয়সালার কোন লক্ষণ নেই। রাজার দশাসই চেহারাকে কিছুতেই বাগে আনতো পারছে না মুন্সি। রাজাও মুন্সিকে কয়েকবার মাথায় তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ। মুন্সি ফড়িং-এর মতো ছটফট করে ঘুরপাক খাচ্ছে সারা থল্লা। কিছুতেই রাজার হাতের মুঠোয় ঠিক মতো ধরা দিচ্ছে না। তার সাহস দেখে রাজার মাথায় যেন আগুন ধরে গেলো। একটা সাধারণ লোক তাকে চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহস পায় কী করে? মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে-
: একবার বাগে পেলে হয়, মুন্সিকে সে এমন শিক্ষা দেবে যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ জানাবার আগে দশ বার ভাবে!
হঠাৎ ভোজবাজির মতোই ঘটনাটা ঘটে! সবার চক্ষু তো চরকগাছ। হয়তঃ জেদের বশেই একটু অন্যমনষ্ক হয়েছিলো রাজা। আর অমনি মুন্সি রাজার দেহটাকে মাথার উপর তুলে খুশীতে চিৎকার করে চক্কর দিতে লাগলো চরকির মতো।
অবিশ্বাস্য ঘটনা। হৈহুলোর করে মাঠে ঢুকে পড়লো একদল লোক। বল্লানটিয়াররা তৎপর হয়েও সহজে বাগে আনতে পারলো না তাদের। দেখতে দেখতে আধঘন্টা পার। শেষ পর্যন্ত বহু কষ্টে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো ।
খেলা শেষ। বাশি বাজিয়ে দিলেন রেফারি। জয় মধ্য পাড়ার। কিন্তু সেরা খেলোয়ারের পুরস্কারটা নিয়ে গেলো মুন্সি মিয়া।
খেলা শেষ হলে কী হবে, প্রায় দিন পনেরো এই খেলা নিয়েই হট কেকের মতো আলোচনা, সমালোচনা চললো সব জায়গায়। এমনকি চায়ের দোকানে, গুদারাঘাটে এবং বিকালে খেলার আড্ডাতেও সেই একই আলোচনা। বড়রাও কোন কারণে একত্রে বসলেই প্রাথমিক আলাপ হিসেবে খেলার চুলচেরা বিশ্লেষণগুলো তুলে আনছেন অবলীলায়। কিন্তু সব কথার এক কথা, মুন্সি মিয়ার প্রশংসা না করে পারলো না কেউ। এক কথায় এলাকায় হিরো এখন মুন্সি মিয়া।
(চলবে——)

‘রঞ্জুর ছেলেবেলা’-থেকে

 

Related posts

Leave a Comment