চীন-মার্কিন মুখোমুখি অবস্থায়, শান্ত তাইওয়ান

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর বিশ্বরাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। পেলোসির তাইওয়ান সফর রাজনৈতিক অঙ্গনে কেন এত হইচই ফেলছে, তা অজানা নয় কারো কাছেই। ইউএস হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার হিসেবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই তার অবস্হান। পেলোসি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের একজন। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতাও তিনি। যেহেতু বিগত ২৫ বছরে তুলনামূলক এই স্তরের কোনো মার্কিন কর্মকর্তা তাইওয়ান সফর করেননি, মূলত এ কারণেই পেলোসির আকস্মিক সফরকে কেন্দ্র করে নানা জল্পনা-কল্পনা দানা বাঁধতে দেখা গেছে। এই সফরের প্রাক্কালে তাইওয়ান প্রণালিকে ঘিরে সম্ভাব্য ‘চতুর্থ সংকট’ সৃষ্টির আশঙ্কার কথা বলছেন অনেকেই। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছিলেন, ‘আগুন নিয়ে খেললে তার ফলাফল খারাপ হবে, আগুনে হাত পুড়বে।’ এরূপ টানটান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্হিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার কথাও বলেছেন অনেক বিশ্লেষক।
তবে এতকিছুর মধ্যেও তাইওয়ানের নাগরিকেরা স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছেন। জীবন এগিয়ে চলেছে যথারীতি। তাইওয়ানিজরা আসলে এমন একটি জাতি, যারা দীর্ঘকাল ধরে এমন একটি প্রকৃতিতে বসবাস করে আসছে, যা ভূরাজনৈতিকভাবে ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে আখ্যায়িত। বছরের পর বছর তাইওয়ানিজদের চাওয়া-পাওয়া কিংবা অনুভূতিকে গ্রাস করে চলেছে দোরগোড়ায় শোডাউন দেওয়া ‘গ্রেট পাওয়ার’।
চীন ঘোষণা করেছে, পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আগামী দিনগুলোতে তাইওয়ানের চারপাশে ‘লাইভ-ফায়ার এক্সারসাইজ’ চালিয়ে যাবে তারা। তবে মনে রাখতে হবে, চীনা সামরিক মহড়া-হুমকি তাইওয়ানের জন্য কোনো নতুন বিষয় নয়। বেইজিং দ্বীপটিকে নিজেদের সার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে বরাবরই, যদিও এটি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন। চীনা আগ্রাসনের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টার’। তাইওয়ান বিশ্বাস করে যে, চীন কয়েক দশক ধরে তাদের দিকে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে রেখেছে।
উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। গত অক্টোবরে তাইওয়ানের এয়ার আইডেন্টিফিকেশন জোনে রেকর্ড-সংখ্যক যুদ্ধবিমান ওড়ায় চীন। অতি সম্প্রতি তাইওয়ানের কয়েকটি দূরবর্তী দ্বীপে চীনা যুদ্ধজাহাজের আনাগোনা বেড়েছে। লানিউ দ্বীপে দেখা গেছে চীনা যুদ্ধজাহাজ। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এসব সামরিক মহড়া কিংবা হুমকি এখন পর্যন্ত সাধারণ জনগণকে ততটা আতঙ্কিত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ক্রমবর্ধমান হুমকির মাধ্যমে তাইওয়ানে ‘তীব্র আতঙ্কাবস্হা’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বেইজিং এখন পর্যন্ত কার্যত ব্যর্থ। নতুন কোনো হুমকি, সামরিক মহড়াকে চীনের দীর্ঘকাল ধরে চালিয়ে আসা হুমকি-মহড়ার পুনরাবৃত্তির অংশ মনে করে তাইওয়ানের জনগণ।
চীন দাবি করে আসছে, অনাদিকাল থেকেই তাইওয়ান তাদের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই ইতিহাস বরং আরো বেশি জটিল। ১৭ শতকে শুধু কিং রাজবংশের সময়কালে চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাইওয়ান। কিন্তু সে সময় পুরো তাইওয়ান চীনের সঙ্গে অন্তভু‌র্ক্ত হয়নি। দ্বীপের শুধু একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করত কিং রাজবংশ এবং সেই অংশও এতে বিশেষ আগ্রহী ছিল বলে শোনা যায়নি। ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধের পর তাইওয়ানকে জাপানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। চীনের গৃহযুদ্ধের পর কমিউনিস্টদের পাল্লা ভারী হলে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিজিতের পক্ষে। কুওমিনতাং (কেএমটি) অভিবাসীদের একটি নতুন ঢেউ নিয়ে আসে বটে; তবে তাইওয়ান রয়ে যায় স্বৈরাচারিতার জাঁতাকলেই। তত্কালীন সময়কালের এই ঘটনা ইতিহাসে ‘হোয়াইট টেরর’ নামে অবিহিত।
বিগত কয়েক দশক ধরে তাইওয়ানে একটি সমৃদ্ধ গণতন্ত্র গড়ে উঠেছে। তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে। তাইওয়ানে ‘স্হিতাবস্হা’ বজায় রাখার পক্ষে কথা বলে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি। দলটি স্হিতাবস্হাকে পুরোপুরি সমর্থন করে (কেননা, এই অস্পষ্ট অবস্হান না নিয়ে উপায় কী; যেখানে তাইওয়ান প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন নয় পুরোপরি)। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে অব্যাহতভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কেএমটি। ‘ঐক্যের রাজনীতি’র সমর্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। যদিও সাম্প্রতিক নির্বাচনে মার খেয়েছে তারা। এরপর থেকে চীনপম্হী ভাবমূর্তি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে কেএমটি। তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষ স্হিতাবস্হাকে সমর্থন করে বলেই মনে হয়। কেবল ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুরা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ণ স্বাধীনতা চায়; কিংবা চীনের সঙ্গে একীভূত হতে চায়। তবে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ যুক্তি রয়েছে যে, চীনের কাছ থেকে কোনো ধরনের হুমকি না এলে তাইওয়ানিজরা স্হিতাবস্হার পরিবর্তে পাকাপোক্তভাবে স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলবে।
যখন পেলোসির প্রত্যাশিত সফরের খবর তাইওয়ানে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমি পূর্বাঞ্চলে সমুদ্রতীরবর্তী হুয়ালিয়েন নামক এক গ্রামীণ এলাকায় ছিলাম। এই এলাকা মধ্য তাইওয়ানের পাহাড়ি ভূখণ্ডের সঙ্গে মিশে সমুদ্রসৈকতে গিয়ে পড়েছে। হুয়ালিয়েন মূলত সামরিক ঘাঁটির হোস্ট হিসেবে সমধিক পরিচিত। সংঘর্ষ বা চীনা বিমানের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তাইওয়ানের ফাইটার জেট মোতায়েনের দরকার পড়লে এই হুয়ালিয়েনই হয়ে উঠবে তার কেন্দ্রবিন্দু।
হুয়ালিয়েনে আমি আদিবাসী কেবালানদের সঙ্গে কাতাবান ফসল কাটার উত্সব উদ্যাপন করছিলাম। কেবালানদের কাছ থেকে আমি শুনেছি বছরের পর বছর ধরে হান ও অন্যান্য গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিকতার মধ্যেও কেবালানরা কীভাবে তাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি আরো কিছু জানতে উদগ্রীব ছিলাম তাদের থেকে। তবে এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বিভ্রান্িত। এমন দাবি করা হয় যে, তাইওয়ানের সব সৈন্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। নিজ নিজ কর্মস্হলে সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের। আমি যে সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাদের মধ্যে একজন সৈনিক ছিলেন। উত্সবে অংশ নেওয়ার জন্য ছুটি কাটাতে বাড়িতে ছিলেন তিনি।
আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, উত্তেজনা বাড়লে তা তাদের পর্যটনের ওপর বেশ বাজে প্রভাব ফেলবে। মহামারির আগে তাইওয়ানে চীনা টু্যর গ্রুপের নিয়মিত পদচারণা একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল। এখন নতুন করে চলমান ‘উত্তেজনাপূর্ণ অবস্হা’ তাইওয়ানকে একটি ধাঁধার মুখে ফেলেছে। কেননা, চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের অর্থনীতি গভীরভাবে জড়িত।
পেলোসির সফরের ঠিক আগমুহূর্তে তাইওয়ানের ১০০টি খাদ্যপণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চীন। চীনের এই পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞার পেছনে তাদের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ ছিল। চীনের উদ্দেশ্য ছিল—চীনা বাজার বন্ধ হওয়ার ভয় দেখিয়ে কৃষক, জেলে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল গোষ্ঠীগুলোকে দিয়ে রাজনৈতিক সম্মতিতে চাপ দেওয়া। এটি করতে চীন পর্যটন খাতকেও ব্যবহার করতে চেয়েছে।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিই আমি। মনোযোগ দিই সেই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে। একপর্যায়ে কেউ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেন—আমি এতটা উদ্বিগ্ন কেন? আমাকে দেখে তারা ব্যঙ্গ করে বলেন, উদ্বেগ-উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলে আমার অনুষ্ঠান উদ্যাপনে মনোযোগ দেওয়া কিংবা বা ক্যামেরায় সৈকতের শান্ত পরিবেশের শট নেওয়ায় ব্যস্ত থাকা উচিত! তাদের এ রকম অদ্ভূত যুক্তির কারণ হলো এটি দেখানো যে, হুমকি-ধমকি, মহড়ার মধ্যেও জীবন সহজ গতিতে চলে তাইওয়ানে।

লেখক: তাইওয়ান ও এশিয়া প্যাসিফিকের অ্যাকটিভিজম ও ইয়ুথ পলিটিকস কভার করা ‘নিউ ব্লুম’ ম্যাগাজিনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন
সূত্র:-ইত্তেফাক

Related posts

Leave a Comment