নিরাগ দেখা

-কাজী মোঃ হাসান

বর্ষার এই সময়টায় মেঘনা পারের মানুষগুলোর হাতে তেমন কোন কাজ থাকে না। তাই প্রতি বছরই কয়েকজন মিলে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বড় বড় নৌকা নিয়ে গাড়িয়ালদের মতো উত্তরে ধান কাটতে যায়।
বর্র্ষা মৌসুম এলেই হঠাৎ করে পাহাড় থেকে তীব্র বেগে পাহাড়ী ঢল নামে। পথ ঘাট ভাসিয়ে একাকার করে দেয়। তলিয়ে যায় পাকা ধান সহ মাঠের নানা ফসল। ইচ্ছে থাকলেও সমস্ত ফসল কাজের লোকের অভাবে ঘরে তোলা যায় না। ভীন জায়গা থেকে আসা ঐ লোকগুলো টাকার পরিবর্তে অথবা একটা নির্ধারিত পরিমাণ ধানের বিনিময়ে তলিয়ে যাওয়া ক্ষেতের ধান বা অন্যান্য ফসল তুলে দেয়। কাটা ফসলে নৌকা বোঝাই হয়ে গেলেই তারা আবার ফিরে আসে নিজ নিজ ঘরে।
যারা উত্তরে যায় না, তাদের মধ্যে কেউ ছৌয়া নাও দিয়ে কেরাইয়া টানে। অনেকে আবার কোথাও না গিয়ে বাড়িতে বসেই গরু-বাছুরের যত্ন নেয়। কেউ কেউ আবার মাছ ধরাকে সাময়িক পেশা হিসেবে বেছে নেয়।
মাছ ধরারও অনেক পদ্ধতি। জোয়ারের সময় খাল-বিলে মাছের চলাচল বুঝে জেলেরা খড়া পাতে। কেউ ধান ক্ষেত বা ঝোঁপের আড়ালে বসে বসে বরশি দিয়ে মাছ ধরে। জোংরা, চাঁই, কইয়া জাল, ছড়ড়া বড়শী দিয়েও মাছ ধরা যায়। এটা খুব সহজ পথ। শুধু জায়গা মতো পাততে পারলেই হলো।
এ ছাড়াও আছে নিরাগ দেখা (যখন এক ফোঁটা বাতাসও থাকে না)। এ সময় কোচ, জুইত্যা বা টেটা, যার যেটা আছে সেটা নিয়েই নৌকায় চড়ে মাছ শিকারে বের হয়। গ্রামের অনেকেই যায়। এরা জেলে বা পেশাদার নয়, শখের মাছ শিকারী।
বর্ষাকালে নিরাগ পড়লেই বড় বড় মাছ জোয়ারের পানির সাথে নদী থেকে পাশের ক্ষেতে উঠে আসে। লেজ দুলিয়ে অলস ভাবে ঝরা ধানের গায়ে ঠোকরাতে ঠোকরাতে শ্যাওলা খায়। ঠোকরের সাথে সাথে চড়েচড়ে উঠে ধান গাছগুলো। শিকারীরা ঐ নড়াচড়াকেই খুঁজে বেড়ায়। একবার চোখে পড়লেই হলো- যতটা সম্ভব কাছে গিয়ে ঠোকর লক্ষ্য করে কোচ, টেটা বা জুইত্যা বা যা-ই থাকুক না কেন, ছুড়ে দেয় মাছের উপর। অনেক সময় মাছের পরিবর্তে সাপ বা কাছিমও টেটায় গেঁথে যায়! তাই শিকারীরা খুব সাবধান না হলে বিপদটা ঘটে তখনি।
ছোট মাছ হলে কথা নেই, খুব সহজেই পানি থেকে তুলে আনা যায়। বড় মাছ হলেই যত ঝামেলা। এতে আনন্দ যেমন, ভুগান্তিও তেমন। বড় মাছগুলো কখনও কখনও সবকিছু ভেঙ্গে-চূরে সোজা নেমে যায় নদীর ভেতর। তীব্র বেগে ছুটতে থাকে দিগি¦দিক- কান্ত না হওয়া পর্যন্ত। মাঝে মাঝে এক থেকে দুই মাইল পর্যন্ত ছুটাছুটি করে- নদীর এ বাঁক থেকে সে বাঁকে। তখন টেটা বা জুইত্যার রশিটা নৌকার গলুইয়ের সাথে বেঁধে রাখতে হয়। নইলে বিপদ ঘটতে বাধ্য।
একবার হয়েছিলো কি- রঞ্জুর আব্বু তখন ইয়ংম্যান। একদিন নৌকা নিয়ে দাদু এবং মেজ কাকার সঙ্গে আব্বুও গেলেন নিরাগে মাছ শিকার করতে। ঘুরতে ঘুরতে এজার কান্দির চকে এসে হাজির। রাত, নয় কি দশটা হবে। জোচ্ছনার আলোতে ফক ফক করছিলো চারদিক।
এক মাথায় লগি-বৈঠা নিয়ে নৌকা চালাচ্ছিলেন মেজ কাকা। পাটাতনে উপর বসে ছিলেন আব্বু। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে সবাই নজর ফেলছিলেন এদিক সেদিক। টেটা হাতে নৌকার অপর মাথায় দাঁড়িয়ে সজাগ দৃষ্টিতে ঝরা ক্ষেতে ধানের ডগার নড়াচড়া খুঁজছিলেন দাদু।
চক পেরিয়ে ডোমারচরের কাছাকাছি নদীটা যেখানে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানে আসতেই কিছুটা দূরে কয়েকটা ধানের ডগা হাতছানি দেয়ার মতো নড়ছিলো একটু একটু করে। শিকারী বাঘের মতো খুব আস্তে আস্তে লগি মেরে প্রায় কাছাকাছি চলে আসেন তারা। তারপর নিশানা সই করে টেটা ছুড়ে মারেন ধানের নড়াচাড়া লক্ষ্য করে।
কিন্তু আশ্বর্য! টেটা মারার পর পানির নড়াচড়া একদম বন্ধ হয়ে গেলো, যেন কিছুই ঘটেনি। দ্বিধায় পড়ে গেলেন সবাই- জিনিসটা কি? কিছুই বুঝা গেলো না দূর থেকে। যদি কিছু না-ই হবে তো এতোক্ষণ নড়াচড়া করলো কি? আর যদি ওটার গায়ে টেটা বিঁধে না থাকে, তা হলে সেটা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো না কেন? কিছু একটা দৌড়ে পালিয়েছে- কই, তেমন দৃশ্য তো কারোর চোখেই পড়লো না! তা হলে বিষয়টা কী ? সবাই দম বন্ধ করে প্রতিটি মুহুর্ত পার করতে লাগলো চরম উত্তেজনার মধ্যে।
আচমকা শুরু হলো তোলপাড়। মাছটা যাতে নদীতে নেমে যেতে না পারে সেজন্য দ্রুত নৌকাটা সেখানে নিয়ে টেটাটা মাটির সাথে প্রাণপণ চেপে ধরলেন দাদু। মাছটা যে বেশ বড় তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মিনিট পনেরো/বিশের পর অনেকটা শান্ত হয়ে এলো সবকিছু। কিন্তু ভয় কাটে না- এ অবস্থায় মাছটা নৌকায় তুলতে গেলে যদি আবার ঝাকুনি দিয়ে ছুটে যাবার চেষ্টা করে তখন রাখতে পারবেন তো? রিক্স নিতে সাহস হলো না। তাই দাদু আব্বুকে ডেকে বললেন- তুই একটু পানিতে নাম, টেটাটা মাটি থেকে তুলার সময় লক্ষ্য রাখবি যেন মাছটা ছুটে যেতে না পারে।
দাদুর কথা মতো আব্বু পানিতে নামলেন। নিজেই মাটি থেকে আস্তে আস্তে মাছ সহ টেটাটা তুলে তার নীচে বাম পা-টা এমন ভাবে এগিয়ে দিলেন যাতে মাছটা নড়াচড়া করলেও ছুটে যেতে না পারে। আর চরম বিপদ ঘটেলো ঠিক তখনি।
আশে-পাশে পানির নড়াচড়া টের পেয়ে মাছটা শেষ বারের মতো প্রাণে বাঁচার জন্য নড়ে উঠলো পূর্ণ শক্তিতে। কিছু বুঝার আগেই মাছ ছুটে যাওয়ার ভয়ে টেটাটা আবার চেপে ধরলেন দাদু। আর যায় কোথায়! সাথে সাথে মাছ সহ টেটা এফোড় ওফোড় হয়ে গেঁথে গেলো আব্বুর পায়ে। সে এক মহা হুলুস্থুল কা-! এরপর পাক্কা তিন মাস ডাক্তারের নজরদারিতে ছিলেন আব্বু।
আর একদিনের কথা। নিরাগ দেখতে গিয়ে টেটায় মাছ গাথলেন দাদু। টেটার রশির এক মাথা নৌকার গলুইয়ের সাথে বেঁধে বাকিটা ছুড়ে দিলেন পানিতে। কিছু একটা গোলমালের অপেক্ষায় রইলেন সবাই।
কিন্তু অবাক ব্যাপার! সুযোগ পেয়েও মাছটা না কোন দিকে ছুটছে, না ঝড় তুলছে পানি কাঁপিয়ে। সব চুপচাপ। কতক্ষণ গেলো কে জানে! এক সময় পানি থিতিয়ে এলো আশপাশের। এ অবস্থায় কি করা যায় তাই ভাবছিলো সবাই।
হঠাৎ আশেপাশের ধানগাছগুলো দুমরে মুচরে আঁটি বাধার মতো একসাথে জড়ো হতে লাগলো। ব্যাপারটা দেখে মেজ কাকা তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন-
– সাবধান বাবা! ওটা মাছ না। নিশ্চয় বড় কোন সাপ হবে। দেখছেন না, লেজ দিয়ে আশে পাশের ধানগুলো কেমন একত্র করে ফেলছে?
দাদু ভালো করে দেখে-শুনে কাকার কথায় একমত হলেন-
– সত্যি রে, এটা মাছ বলে তো মনে হচ্ছে না!
শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো- কাকার কথাই ঠিক। এটা ছিলো প্রায় দশ হাত লম্বা ও ইয়া মোটা একটা অজগর সাপ। হয়তঃ কোন পাহাড় থেকে বন্যার পানিতে ভাসতে ভাসতে এখানে চলে এসেছে।
রঞ্জু জীবনেও অজগর দেখেনি। তবে শুনেছে, অজগর নাকি আস্তে একটা ছাগল, হরিণ এমনকি মানুষ পর্যন্ত গিলে ফেলতে পারে। কী সাঙ্গাতিক ভয়ের কথা!
সেই থেকে দাদু রাতের বেলা নিরাগ দেখা প্রায় ছেড়েই দিলেন। তবে দিনের বেলা নিরাগ পড়লে আগের কথা কিছুই মনে থাকতো না তাঁর। বের হয়ে যেতেন নৌকা নিয়ে। দাদুর সঙ্গে প্রায়ই রঞ্জুও যেতো। ধরা পরা মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, নলা এবং বাগনার সংখ্যাই বেশী। মাঝে মাঝে বোয়াল, চিতল, মৃগেল মাছও থাকতো।
রঞ্জু জীবনে একবারই টেকা মাছ ধরেছিলো। তাও আবার বরশি দিয়ে মেজ কাকার সাথে। নৌকায় চড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। টেকা মাছ দেখতে অনেকটা রূপচাঁদার মতো। এ মাছটা রূপচাঁদা থেকে ছোট এবং চান্দা মাছ থেকে বড়। বড়শি থেকে খুলে জেতা জেতা মাছগুলো নৌকার হালকা পানিতে ছেড়ে দিলেই তিরতির করে ছুটে পালাতো মুক্তির আনন্দে। এসব দেখতে রঞ্জুর কী যে ভালো লাগতো তখন!
(চলবে——)
(‘রঞ্জুর ছলেবেলো’ থকে)

 

Related posts

Leave a Comment