ফাঁদ

-কাজী মোঃ হাসান

মিয়াজদ্দিন এবং তার ভাই সাহাজদ্দিনও রঞ্জুর ভালো বন্ধু। তাদের বাবা একজন পাখি শিকারী। তাদের বাড়িতে গেলেই দেখা যায় কোড়া, ডাহুক, বক, বালিহাঁস, রাজহাঁস, চিনাহাঁসের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা উঠোন জুড়ে। এ ছাড়া খাঁচায় এক জোড়া ঘুঘু এবং কাঠের খোপে কবুতরের ঝাঁক। এক একটার এক এক নাম। গিরিবাজ, জালালী আরো কতো কী! অত নাম রঞ্জুর মনে থাকে না।
সকালে খাঁচার ঢাকনা খুলে দিলেই গিরিবাজ কবুতরগুলো পাখা ঝাঁপটিয়ে ফুরফুর করে উড়ে যায় আকাশে। কোনটা আবার ঘরের চালে, গাছের ডালে অথবা বাঁশ দিয়ে তৈরী উচু মাচানের উপর গিয়ে বসে। উঠোনেও দেখা যায় কয়েকটাকে। গর্বিত পা ফেলে বাকুম বাকুম শব্দ করে বারবার আড় চোখে আকাশটাকে দেখে। যে যেখানেই থাক না কেন, মিয়াজদ্দিন হাত তালি দিলেই ওগুলো দল বেঁধে ডিগবাজি খেতে খেতে উড়ে যায় একদম শূন্যে। আবার হাত তালির দিলে নেমে আসে মিয়াজদ্দিনের হাতের তালুতে। দৃশ্যটা দেখতে রঞ্জুর ভীষণ ভালো লাগে। আর এভাবেই কবুতর পোষার ইচ্ছেটা তার মনের ভেতর একটু একটু করে দানা বাঁধে।
আর একটা পাখির প্রতি রঞ্জু খুব দুর্বল। নাম কোড়া। বর্ষাকাল এলেই পাখিগুলোর দেখা মেলে। বর্ষা শেষ হলেই আবার উধাও। কোত্থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায় তা আল্লাহ্ই জানেন। শুকনার দিনে একটা কোড়াও চোখে পড়ে না।
এরা এসেই পানিতে ভাসমান ধানগাছ একত্র করে বাসা বাঁধে। বাসাটা দেখতে অনেকটা হাতলওয়ালা চেয়ারের মতো। রঞ্জু নিজে পরীক্ষা করে দেখেছে। ভীষণ সুন্দর বাসা, বাড়ি নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে!
সন্ধ্যায় মাগরিবের আযান পড়তে না পড়তেই শুরু হয় কোড়াদের ‘টুল্লুফ’ ‘টুল্লুফ’ ডাক। সে ডাক বর্ষার পানিতে ভাসতে ভাসতে আশে পাশের গ্রামগুলোতে হোচৎ খায়। সূর্য ডোবার মুহুর্তে আযান এবং কোড়াদের প্রাণ খোলা ডাক প্রকৃতির স্তব্দতাকে খান খান করে ভেঙ্গে দেয়। রঞ্জুর কাছে সে এক ভীষণ ভালো লাগা মুহুর্ত।
মিয়াজুদ্দির বাবা কোড়া শিকারে ওস্তাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে তাদের পালা কোড়াটা খাঁচার ভরে নৌকায় চড়ে বসেন তিনি। বের হয়ে যান কোড়া শিকারে। এ সময় সঙ্গে থাকে লম্বা বাঁশের মাথায় চা ছাকনির মতো বড় থলেওয়ালা জাল।
বন্য কোড়াটার বাসার কাছাকাছি পৌঁছেই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোড়াটা ছেড়ে দেন তিনি। ছাড়া পেয়েই ওটা ‘টুল্লুফ টুল্লুফ’ শব্দে গলা ফাটিয়ে ডাকতে আরম্ভ করে। ডাক শুনে এক সময় বন্য কোড়াটাও গলা মেলায়। ডাকতে ডাকতেই এক সময় দু’জনে কাছাকাছি আসে। ভাব জমে। এক সময় বন্ধু হয়ে যায় দু’জন।
সুযোগের অপেক্ষায় থাকে পালা কোড়াটা। এক সময় বন্য কোড়াটাকে পায়ের নখরে পেঁচিয়ে ফেলে পালা কোড়াটা। সঙ্গে সঙ্গে টুল্লুফ’ ‘টুল্লুফ’ শব্দে মালিককে জানিয়ে দেয় কোড়া ধরার খবর। আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন মিয়াজদ্দিনের বাবা। ছুটে যান সেখানে। তারপর জাল ফেলে ধরে ফেলেন কোড়াটাকে। এ ভাবেই চলে কোড়া শিকার। সত্যি, বিষয়টা ভীষণ মজার এবং উত্তেজনাকর! একদিন রঞ্জু গিয়েছিলো তাদের সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, একটা কোড়াও ধরা পরেনি সেদিন।
কোড়া ধরা এবং পালা দুটোই খুব কঠিন। তার চেয়ে কবুতর পালা অনেক সোজা! তাই মিয়াজদ্দীনের সহযোগিতা নিয়ে কবুতরের খাঁচা বানিয়ে ফেলে একটা। কাঠের খাঁচা। মাঝারি আকারের। চার জোড়া কবুতর রাখা যাবে এক সাথে।
কিন্তু বাঁধ সাধলেন আব্বু। কবুতর কিনে দিতে ঘোর আপত্তি। তাঁর আশঙ্কা, এ নিয়ে মাতামাতি করলে লেখাপড়ার ক্ষতি হতে বাধ্য। রঞ্জু আব্বুকে কথা দেয়, সে লেখাপড়ার একদম ক্ষতি করবে না। তার পরও আব্বুর না। শেষ-মেশ অনেক কান্নাকাটি, অনেক অনুনয় বিনয়, সে সাথে আম্মুর সুপারিশের বদৌলতে দুই জোড়া কবুতর কিনে দিতে রাজি হলেন তিনি।
এখন লেখা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রঞ্জুর একটাই কাজ, সময় মতো কবুতরগুলোর যতœ নেয়া, পানি দেয়া, খাবার খাওয়ানো। যত্ন নেয়ার কাজাটাতে ঝক্কিঝামেলা থাকলেও আনন্দ অনেক।
একদিন মিয়াজদ্দিন দেখতে আসে তার কবুতর। সাদা জোড়াটা দেখেই খুশীতে লাফিয়ে উঠে-
: এই রঞ্জু, তোর সাদা জোড়াটা শিগশিরই ডিম দেবে। দেখে-শুনে রাখিস কিন্তু।
: তাই নাকি?
খবরটা শুনে রঞ্জুও খুশীতে আটখানা । এবং সেদিন থেকেই যত্ন-আত্তিটা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
প্রথম দিকে এতোটা ছিলো না। কয়েকদিন থেকেই বিড়াল ও ডিগলানজার উৎপাত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। সকাল-সন্ধ্যায় যখন তখন হানা দিচ্ছে কবুতরের খাঁচায়। এই নিয়ে রঞ্জু খুব বিরক্ত, অতিষ্ঠ। শিয়াল বেটাও কম যায় না। যেমন ধূর্ত তেমন সাহসী। এতোসব শক্রুর মোকাবেলা করে কবুতর পালা সত্যি খুব ঝামেলার। অšততঃ রঞ্জুর তা-ই মনে হয়! সে ভাবতেই পারে না, মিয়াজদ্দিনরা কী ভাবে এতো ঝামেলা সামলায়!
একদিনের মধ্যেই তালা কিনে, তারের নেট লাগিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তা সত্ত্বেও তিন মাসের বেশী কবুতরগুলোকে ধরে রাখা গেলো না।
একদিন ঘুম থেকে উঠে খাবার দিতে গিয়ে তার চক্ষু স্থীর। দেখে খাঁচার ঢাকনাটা হাট হয়ে খোলা। ভেতরে একটা কবুতরও নেই। আশে পাশে কবুতরের পালকগুলো পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। কবুতর হারাবার যন্ত্রণাটা বুকের ভেতর কষ্টের আলোড়ন তুলে। দু’তিন দিন ভীষণ চুপচাপ থাকে। শোকে দুঃখে কারো সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করেনি রঞ্জুর।

কবুতর পালার পাশিপাশি এরই মধ্যে মিয়াজদ্দির কাছ থেকে অন্য একটা বিদ্যাও শিখে ফেলে। বিদ্যাটা- ফাঁদ তৈরী। আসলে, ব্যাপারটা এ রকম- তালগাছের ডাল পঁচিয়ে তার ভেতর থেকে কালো এবং চিকন এক ধরণের তন্তু বের করা যায়। সেটাকে কালো সুতা দিয়ে বেঁধে তাতে আংটি পড়িয়ে বক, ডাহুক, শালিক ইত্যাদি ধরার ফাঁদ তৈরী করা যায়। সেটাই শিখে ফেলেছে সে। বিদ্যাটা শেখার পর থেকে রঞ্জু মনে মনে নিজকে সাঙ্গাতিক কিছু ভাবতে শুরু করে।

এই ফাঁদটা বক বা ডাহুকের চলাচল বুঝে বনের কাছাকাছি পুতে রাখলেই ব্যাস্- এ পথে বন থেকে বেরিয়ে আসলেই কেল্লা ফতে, আটকা পড়তে বাধ্য।
কিন্তু রঞ্জুর ভাগ্য খারাপ। কয়েকদিন খাটাখাটি করে একটা ফাঁদ তৈরী করলেও এটা দিয়ে কোন কিছু ধরতে পারেনি। অথচ তাদের বাঁশ ঝাড়ের ঝোঁপেই সারাদিন ডাহুকগুলো ঘুরাফেরা করে। ডাহুক ধরতে না পারার রহস্যটা যে কি, আজো আবিষ্কার করতে পারেনি সে! শেষ পর্যন্ত হতাশার কারণে এই প্রজেক্টটাও আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যায়।
ডাহুক ধরার প্রজেক্ট বাতিল হলে কী হবে, বিদ্যাটা পরখ করার ইচ্ছা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারে না। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে কেবল ঘুরপাক খায়- কখন এবং কি ভাবে বিদ্যেটা কাজে লাগানো যায়।

একদিন খুব চিন্তাভাবনা করে, রাতে ফাঁদ তৈরীর সম¯ত মালমশলা জোগাড় করে, খাটের নীচে লুকিয়ে রাখে দু’ভাই। পরদিন দুপুরে আম্মু যে-ই গোসল করতে গেছেন, অমনি মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে ফাঁদটা তৈরী করে ফেলে জটপট। তারপর পেতে রাখে এমন এক জায়গায়, যে পথে রঞ্জুদের বেড়ালটা আসা যাওয়া করে রাত দিন, শতবার।

এই বিড়ালটাকে নিয়ে কিছু না বললেই নয়। এমন বিড়াল জীবনে আর একটাও দেখেনি তারা। পুচকি থাকতেই আব্বু কোত্থেকে যেন এনেছিলেন শখ করে। রংটা একদম ফক-ফকা সাদা। যেমনি ভদ্র তেমনি লক্ষ্মী। সারাদিন দুধ-মাছের পাশে বসে থাকলেও কোনটাতেই মুখ দেয় না। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করলেও না। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটা একশ’ ভাগ সত্যি। বিড়ালটার জন্য নির্ধারিত প্লেটে খাবার না দিলে, অভুক্ত থাকতো সারাদিন। রঞ্জুরা অনেক সময় দুষ্টুমি করে অন্য প্লেটে খাবার দিয়ে দেখেছে- খায়নি। দুধ-ভাত মেখে বিড়ালের মুখের কাছে নিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে দেখেছে, তাতেও কাজ হয়নি। তবে আব্বু বাড়ি ফিরলেই শুরু হতো তাঁর পিছু নিয়ে ঘুরঘুর করা, এবং অন্য প্লেটে খাবার দেয়ার বিরুদ্ধে মিউমিউ করে নালিশ জানানো। আর আব্বু খেতে বসলেই ব্যাস, লাফ দিয়ে একদম তাঁর কোলে।
আজ এই বিড়ালটাকে ধরার জন্যই ফাঁদ পাতা।

এবার ফলাফলের অপেক্ষা। পাশের রুমে চুপচাপ ওৎপেতে বসে থাকে দু’ভাই। দশ-বার মিনিট পর। বিড়ালটা খটাং করে আটকা পড়ে তাদের ফাঁদে। প্রথমে পাত্তাই দেয়নি ফাঁদটাকে। ভেবেছিলো- হয়তঃ মাকড়শার জাল বা অন্য কোন তারে আটকা পড়েছে।
প্রথমে মাথা ঝাঁকিয়ে, তারপর পা দিয়ে খামচে ফাঁদটা ছাড়াবার চেষ্টা করে। তাতে কাজ না হওয়ায় চারিদিকে ঘুরতে থাকে মিউমিউ করে। এতেও কাজ হচ্ছে না দেখে শুরু হয় লাফালাফি আর হুঙ্কার। যত লাফায় ফাঁসটা ততই কষে। চিৎকার, লাফালাফি সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। বাড়িঘর তোলপাড়।

এদিকে ফাঁসটা কষতে কষতে বিড়ালটার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এক সময় ওটা মাটির উপর চিৎ হয়ে পড়ে যায় আর গোঙ্গাতে থাকে। জিহ্বাটা মুখ থেকে বেরিয়ে ঝুলে পড়ে দাঁতের ফাঁক দিয়ে। চোখ দু’টোর দিকে তাকানোই যায় না- আগুনের মতো টকটকে লাল। যেন কামানের গোলা। মনে হয়, এখনই বুঝি ঠিকরে বেরিয়ে আসবে রঞ্জুদের দিকে। অবস্থা এমন যেন এক্ষনি মরে যাবে বিড়ালটা। কী ভয়ঙ্কর আর বীভৎস সে দৃশ্য! চোখের সামনে প্রিয় বিড়ালের এই মৃত্যু দৃশ্য দেখা সত্যি খুব কষ্টকর। তাই বলে কাছে গিয়ে বিড়ালটাকে মুক্তা কারার সাহস তাদের নেই।
বিড়ালের মৃত্যু-ভয়টা ভারী পাথরের মতো ধাক্কা দেয় রঞ্জুর বুকের ভেতর। উপায় না দেখে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে তারা। চিৎকার শুনে- কী হয়েছে দেখতে ছুটে আসেন বাড়ির সবাই। দাদী, চাচী সহ আশে পাশের বৌ-ঝিরাও বাদ নেই। আম্মু গোসল রেখেই ছুটে আসেন হন্তদন্ত হয়ে।

ব্যাপার দেখে সবাই তো হতবাক। একদিকে বিড়ালের লাফালাফি, অন্যদিকে পরস্পরের গলা জড়িয়ে ধরে দু’ভাইয়ের তারস্বরে চিৎকার। এ ছাড়া রঞ্জুদের রান্না ঘরের হাড়ি-পাতিল ভেঙ্গে একাকার। সে এক লন্ডভন্ড দৃশ্য।
তারাতারি রশিটা কেটে বিড়ালটাকে উদ্ধার করলেন তারা। আম্মু এসে চটাচট কয়েকটা থাপ্পর লাগালেন রঞ্জুর গালে-
: তোরা কী আমাকে দু’দন্ড শান্তিতে থাকবে দিবি না?
রাগে ফুসতে ফুসতে আরও কয়েক ঘা লাগাবার জন্য লাঠি তুলে নিতেই বাঁধা দিলেন দাদী। সামনে দাঁড়িয়ে প্রাচীরের মতো আড়াল করে ফেলেন দু’ভাইকে। তবে রঞ্জুরা ঠিকই বুঝতে পারে, তাদের কাজটা কিছুতেই ঠিক হয়নি।

(চলবে…………..)
(‍রঞ্জুর ছেলেবেলা” থেকে)

 

Related posts

Leave a Comment