ফড়িং শিকারে রঞ্জু

-কাজী মোঃ হাসান

শীতের এ সময়টায় চকের পর চক জুড়ে শুধু রবি শস্য। মূলা, মটর, বুট, সরিষা, কলই, ডাল- কী নেই মাঠে। তবে বেশী ভাগই সরিয়া। সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে সারা মাঠ। কোন কোন ক্ষেতে সূর্র্র্র্যমূখি। কোন ক্ষেতে তিশি। ফুল ফুটলেই মাঠে মাঠে ভ্রমর, মৌমাছি, ফড়িং সহ হাজার রঙ্গের প্রজাপতির উৎসব।
একদিন বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে সরিষা ফুল দেখতে গেলো রঞ্জু। হলদে রঙ্গেও ফুলগুলো দেখতে অসম্ভব সুন্দর। গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। ফুলের গন্ধ নিতে গেলে পরাগরেণু নাকের ডগায় লাগবেই। তারপরও ভালো লাগে গন্ধ নিতে। ফুলগুলো হালকা বাতাসে যখন দোল খেয়ে যায় তখন মনে হয় এই বুঝি পদ্মা মেঘনা যমুনার আহ্লাদি ঢেউ। একটা ফুল আর একটা ফুলের উপর যেন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। রঞ্জু অবাক চোখে ফুলগুলোর এই আহ্ণাদীপনা দেখে আর তৃপ্তিতে হাসে।
প্রজাপতি, ফড়িং, ভ্রমরা এসব ধরার খুব সখ রঞ্জুর। তবে ধরার জন্য কয়েকটা ফড়িং-এর পিছু পিছু দৌড়াদৌড়ি কওে কাটিয়েছে অনেকটা সময়। আর বুঝেছে- কাজটা খুব সহজ নয়। কাছে গিয়ে যেই ধরতে গেছে অমনিই ফুরুৎ। চোখের পলকে উড়ে গেছে এই গাছ থেকে অন্য গাছে। তার এই দৌড়াদৌড়ি দেখে খলিল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়-
: ধুর বোকা! এ ভাবে কেউ ফড়িং ধরে?
: তা হলে কী ভাবে ধরে?
: আরে ফড়িং ধরতে গেলে আঠা লাগে। আঠা ছাড়া সহজ ভাবে ফড়িং ধরার আর কোন উপায় নেই।
: কিসের আঠা। একটু খোলসা করে বল না রে ভাই! ধৈর্য্য ধরে না রঞ্জুর।
: এই ধর, লম্বা কাঠি বা পাটশলা নিবি। সেটার মাথায় যে কোন আঠা লাগিয়ে দূর থেকে আস্তে আস্তে ফড়িং বা প্রজাপতির পাখার কাছে নিয়ে টুপ করে লাগিয়ে দিলেই হলো, আর পালাতে পারবে না।
: আরে, এতো দেখছি খুব ভালো বুদ্ধি!
সেই থেকে রঞ্জু মনে মনে আঠা দিয়ে ফড়িং ধরার সুযোগটা খুঁজতে থাকে। খলিল ছাড়াও সেদিন রঞ্জুর সঙ্গী ছিলো বাতেন ও রহমত।
এ মাঠেই রঞ্জুদের মটর ক্ষেত। হাটতে হাটতেই ওরা চলে যায় ক্ষেত দেখতে। লতা থেকে কয়েকটা মটর তুলে মুখে দেয় রঞ্জু। ভীষণ কষ্টি, বিস্বাদ। বাত্তি হয়ে যাওয়ায় খাওয়ার অযোগ্য। আর কদিন পরেই মটর শুকুতে শুরু করবে। তবে আগুনে পুড়িয়ে, ভেজে অথবা সিদ্ধ করে খেতে বেশ মজা। অবশ্য আর একটু কাঁচা থাকলে আগুনে না পুড়লেও স্বাদ লাগতো।
হাতের কাছে পেয়েও মটর খাবে না- এটা তো হয় না! তাই হুট করেই মটর পোড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তবে আগুন পাওয়াটাই হলো সবচেয়ে মুশকিল। বাচ্চাদের হাতে কেউ আগুন দিতে চায় না। তবু অনেক ছুটাছুটি পর সমস্যাটার সমাধান করে বাতেন। পাশের গায়ের এক বাড়ি থেকে পাটশলা জ্বালিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আগুনটা নিয়ে আসে।
প্রথমে নাড়া বিছিয়ে তার উপর মটর বিছিয়ে আগুন দেয়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। কাঠি দিয়ে নেড়েচেড়ে মটর পোড়ানো শেষ করে। এবার বাতেন গা থেকে শার্টটা খুলে বাতাস দিতেই ছাইগুলো উড়ে যায়, পরে থাকে আধো পোড়া মটর। রঞ্জুর জীবনে পুড়িয়ে মটর খাওয়ার সুযোগ এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ। উহ! সে কি আনন্দ ! এ আনন্দ কাউকে বুঝাবার নয়!
প্রাণ ভরে মটর খায় সবাই। পকেটেও নেয় যার যত খুশী। পেন্ট-শার্টের পকেট মটরে ঠাসা। এদিকে কালিতে সবার নাক, মুখ, ঠোঁট একদম কালিতারা। পকেটে মটর রাখায় সেগুলোর অবস্থাও লেজে-গোবরে। এক কথায়, যেখানে হাত লেগেছে, সেখানেই কালির দাগ। সব মিলিয়ে চেহারা ডোরা কাটা বাঘের মতো।
প্রথমে এতোটা খেয়াল করেনি কেউ। খেয়াল করলে হয়তঃ সাবধান হতে পারতো। খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি ফেরার সময়ই বিষয়টা নজরে আসে তাদের। কাছাকাছি কোন পুকুরও নেই যে ধুয়ে মুছে ধোপ-দুরস্ত হয়ে নেবে। সুতরাং কালিকুলি নিয়েই ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফেরা। কপালে আজ নির্ঘাত শনির দশা- এতে কোন ভুল নেই।
চুপিচুপি বাড়িতে ঢুকেই দেখে, আম্মু বেত নিয়ে দরজায় খাড়া। সে বুঝতেই পারছে না- এখন কি করবে? আল্লাহ জানেন- আম্মু আগেভাগেই কী ভাবে যেন সব কিছু টের পেয়ে যান!
রঞ্জুর কালি মাখা শরীরটার দিকে তাকিয়ে আম্মু হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না। এই তিন সন্ধ্যে বেলা গোসল করালেও বিপদ- জ্বর না এসে যায়! আবার না করালেও চলে না। রাগটা ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। কষে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন রঞ্জুর গালে। আর একটা মারতে যাবেন এমন সময়, সেই বাড়িওয়ালী দাদী এসে হাজির। তিনি উভয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আচ্ছা করে ধমকে দিলেন আম্মুকে-
: এই যে রঞ্জুর মা! ছেলেটাকে কী তুমি মেরে ফেলবে না-কি? ওকি তোমার বয়সি যে সব কিছু বুঝে? আর একবার কিছু বলেছো তো তোমার খবর আছে।
বলতে বলতে দাদী রঞ্জুকে ধরে এক ঝটকায় নিয়ে গেলেন কুয়া তলায়। নিজ হাতে সাবান দিয়ে যতœ করে সব কালিকুলি ধুয়ে-মুছে কেতাদুরস্ত বানিয়ে ফেললেন মূহুর্তের মধ্যে। এবার জামাটা পরিয়ে ঘরে এনে বসিয়ে দিলেন পড়ার টেবিলে। যাবার সময় আম্মুকে শাসালেন- দেখ বৌ, আর যেন কান্নাকাটি না শুনি!
পরদিন বাংলো ঘরে বসে স্কুলের দেয়া অংক এবং অন্যান্য কাজগুলো গুছিয়ে রাখছিলো রঞ্জু। হঠাৎ মনে পড়ে ফড়িং ধরার কথা। তাড়াতাড়ি লেখালেখি শেষ করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কিন্তু আঠা ছাড়া ফড়িং ধরবে কী ভাবে? আঠা পাবে কই?
ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে ভাতের কথা। আঠা বলতে তো ঘামের আঠা, গাবের আঠা, কাফিলার আঠা অথবা ভাতের আঠা। আপাততঃ ঘাম, গাব বা কাফিলার আঠা পাওয়া দুষ্কর। তাই একটা পাটশলার মাথায় ভাতের আঠা লাগিয়ে ছুটে গেলো মাঠে ছুটে গেলো রঞ্জু। সে নিশ্চিত সরিষা ক্ষেতে ফড়িং পাওয়া যাবেই।
একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলো ফড়িং-এর দেখা। সরিষা গাছের একদম চূড়ায় বসে বাতাসে দোল খাচ্ছে একটু একটু করে। অথচ কি আশ্চর্য! আঠার কাঠিটা পাখায় ছোঁয়ালেও কাজ দিলো না। ফড়িংটা উড়ে যায় অন্য ডালে। এ ভাবে যেটাই ধরতে গেছে, সেটাই হাওয়া। পরপর কয়েকবার। শেষমেশ ফড়িং বা প্রজাপতি কোনটাই ধরা গেলো না। শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরে আসতে হলো তাকে।
পরদিন শুক্রবার। মক্তব ছুটি। হাতে অফুরন্ত সময়। দশটার মধ্যেই খলিল এবং রঞ্জু দু’জন আম তলায় এসে হাজির। এবারের মিশন- কাফিলার আঠা খোঁজা। গাছের অভাব নেই। বলতে গেলে প্রায় বাড়িতেই গাছটা আছে। কিন্তু আঠা নেই কোন গাছেই।
খলিলদের গ্রাম ঘুরে আঠা না পেয়ে এবার মোল্লা বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তারা। যেতে যেতে হঠাৎ চোখ পড়ে ধ্যইনছা ক্ষেতের পাশের কাফিলা গাছটার দিকে। দেখে, আঠা ঝুলছে। আঠা আবিষ্কারে রঞ্জুরা ভীষণ খুশী। আবার হতাশও। কারণ, আঠাটা এতোটাই উচুতে যে পাড়া কষ্টকর। পাটশলা দিয়েও নাগাল পাওয়া অসম্ভব। গাছে উঠে পাড়বে তারও সুযোগ নেই। কারণ, দু’জনের একজনও গাছে উঠতে জানে না। সুতরাং এ যেন- ‘গাছে কাঠাল গোফে তেল’।
এখন কি করা যায়, এই নিয়ে ভাবতে বসে দু’জনে?
হঠাৎ চিৎকার করে উঠে খলিল-
: পেয়েছি, পেয়েছি!
: কি পেয়েছিস?
: আঠা পড়ার উপায়। আয়, এক কাজ করি- আমি গাছে উঠব, তুই নীচ থেকে আমাকে কাঁধে তুলে নিবি। তারপর ঠেলে দিবি উপরের দিকে। আমার বিশ্বাস আর এক হাত উঠতে পারলেই ব্যাস! কাঠি দিয়ে আঠার নাগাল পাবো।
হলোও তাই। খলিলকে কাঁধে তুলে একটু চেষ্টা করতেই আঠার নাগাল পেয়ে গেলো তারা। কাঠির মাথায় আঠা নিয়ে নেমে এলো খলিল। দুই বন্ধুর মুখে হাসি আর ধরে না। এ হাসি বিজয়ের হাসি!
এবার কাঠিতে আঠা লাগিয়ে সোজা মাঠে। শুরু হয় ফড়িং ধরা। আধ ঘন্টার মধ্যে সাতটা ফড়িং ধরে ফেললো তারা।
এখন আরএক বিপদ। এতোগুলো ফড়িং জীবিত আটকে রাখাই মুশকিল। একটু জোরে ধরলেই মরে ভুত, আবার হালকা করে ধরলেই ফুড়–ৎ। এভাবে ছুটেও গেছে দু’টি। তাই আপাততঃ ফড়িং ধরা বন্ধ করে ফিরে আসে বাড়িতে।
এবার ফড়িংগলো আটকে রাখার বুদ্ধির দরকার। ভাবতে ভাবতেই পেয়ে যায় বুদ্ধিটা। ফড়িংয়ের লেজগুলো বেঁধে ফেলে সূতা দিয়ে। এখন নিশ্চিন্ত। এখন ছেড়ে দিলেও সূতার ভাড়ে না বেশী উচুতে উঠতে পারছে, না যেতে পারছে বেশী দূর। উঠলেও কোন ক্ষতি নেই। দৌড়ে সূতাটা ধরে ফেললেই ব্যাস, সব মুঠোর ভেতর। ভীষণ মজার খেলা। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ফুড়িং উড়ানোর খেলা। তারপর একটা গাছের সাথে সেগুলো বেঁধে বাড়ি ফিরে আসে তারা।
কিন্তু আশ্চর্য, সকালে গিয়েই দেখে সব হাওয়া। একটা ফড়িংও নেই। শুধু সূতোগুলো পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। এর কয়েকটা বাতাসে উড়ছে, কয়েকটা লেগে আছে গাছের সাথে। ভোজবাজির মতোই যেন ঘটে গেছে সব! খলিলের ধারণা, বিড়াল অথবা পাখিদের পেটে গেছে সবগুলো। হতেও পারে। আর এটা সত্যি হলে, কাজটা একদম ভালো হয়নি। বাড়ি ফেরার আগে তাদের উচিত ছিলো ফড়িংগুলো ছেড়ে দেয়া।

(চলবে……………)
(“রঞ্জুর ছেলেবেলা”- থেকে)

Related posts

Leave a Comment