বিডিআর বিদ্রোহ: বারো বছরেও রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার নেই

শুভদিন অনলাইন রিপোর্টার:

বাংলাদেশে ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পর রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা বা তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
ভুক্তভোগীদের পরিবারও অভিযোগ করেছে যে বিচারের নামে তাদের স্বজনদের কারাগারে নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এরপরও তাদের কেউ মামলা করতে বা বিচার চাওয়ার সাহস করছেন না। কারণ ১৩ বছর আগের ওই ঘটনায় অভিযুক্তরা আদৌ কোন বিচার পাবেন কি না সেটা নিয়েই তারা সংশয়ে আছেন।
বিডিআর বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটক হওয়া হাজার জনের মধ্যে তৎকালীন বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক আবদুর রহিমও ছিলেন।
আটক হওয়ার পরের কয়েকদিন পরিবারের সদস্যরা তার কোন খোঁজ পাননি। পরে জেলগেটে দেখা হলে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের বলেন, তাকে রিমান্ডে নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়েছে।

রিমান্ড আর নির্যাতন

আব্দুর রহিমের ছেলে আব্দুল আজিজ সে সময় নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
জেলগেটে বাবার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বাবাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখেন। যন্ত্রণায় দাঁড়াতেও পারছিলেন না।
সতেরো মাসের কারাবাসে এভাবে ১৩ দফা রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল তাকে।
সেখানে অতিরিক্ত নির্যাতনেই বাবার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মি.আজিজ।
তিনি বলেন তার বাবার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।
”প্রথম দিনই তো আব্বুকে বাঁশ দিয়া পিটাইসে। তারপর থেকে আব্বুর কোন চিকিৎসা হয় নাই।”
”আমি যখন দেখতে গেসি, উনি হাঁটতে পারছিলেন না, দাঁড়ায় কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না,” তিনি বলেন।

বাহিনীটির নিজস্ব আইনে চারহাজারের বেশি জওয়ানের সাজা হয়েছে।

শরীর গভীর জখমের চিহ্ন

মি. রহিমকে রিমান্ডে ২৭ থেকে ২৮ দিন রাখা হয়েছিল বলে জানান ছেলে মি. আজিজ।
বাবার মুখ থেকে শোনা অভিজ্ঞাতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “রিমান্ডে প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যে আব্বু ছিলেন।।
এবং আব্বুর পাশে যারা ছিলেন তাদের আর্তচিৎকারও আব্বু শুনসেন।”
আবদুর রহিমের লাশ পরিবারের হাতে বুঝিয়ে দিলে ছেলে আব্দুল আজিজ তার দাফন কাফনের কাজ করেন।
সে সময় তিনি তার আবার পায়ে, পিঠেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গভীর জখমের চিহ্ন দেখতে পান।
সুরতহাল রিপোর্টেও সেই জখমের বর্ণনা আছে বলে বিবিসিকে জানান মি. আজিজ।

বিজিবি’র নতুন লোগো, ডানে বিডিআর এর পুরাতন লোগো

সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি

নির্যাতনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন পরিবারই মামলা করেনি, বিচার চায়নি কিংবা সরকারের পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
কারাগারে আবদুর রহিমের মৃত্যুর ঘটনায় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অপমৃত্যুর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত কোন অভিযোগপত্র দায়ের হয়নি।
আর বিচার চাইলেও বিচার পাবেন কিনা সেটা নিয়েই সংশয়ে আছে মি. আজিজের পরিবার।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে রিমান্ড মানে প্যাঁদানি। এগুলো যতদিন চলবে ততদিন আসামীপক্ষরা সবসময়ই আতঙ্কের মধ্যে থাকবে। মামলা করার কথা মাথায় আসবে না।”
আবদুর রহিম মারা যান ২০১০ সালের ২৯শে এপ্রিল। সে সময় মি. আজিজের ভাইবোন সবার বয়স ছিল অনেক কম। মা গ্রামে থাকতেন। খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। এ কারণে তারা মামলা করবেন কিনা সেটাই বুঝে উঠতে পারেননি।
তবে এখনও মি আজিজ বলেন, “যা হয়ে গেসে তা নিয়ে আর চিন্তা করি না। আমরা এখন খালি বাঁচার কথা ভাবি।”

আটক অবস্থায় ব্যাপক নির্যাতন

বিডিআর বিদ্রোহের এই বিচারকাজ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১২ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে বলা হয় রাষ্ট্রীয় হেফাজতে অন্তত ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের অনেককে আটক অবস্থায় ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে সংস্থাটি।
তাদের কাউকেই আইনজীবীর সহায়তা নিতে দেয়া হয়নি। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
নূর খান সে সময় বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তদন্ত পরিচালক ছিলেন। তিনি বিচারকাজ নিয়ে তার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
তার মতে, তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার কার্যক্রম নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।
তদন্ত চলাকালীন জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায়ে অনেকের মৃত্যুর ঘটনা তিনি জানতে পেরেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখেছেন।
“একজনের মরদেহ আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেখেছিলাম, যেখানে স্পষ্টতই নির্যাতনের চিহ্ন ছিল,” বলেন, মি. খান।
এরকম আট জনের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং যারা মরদেহ দেখেছেন তাদের থেকে এই তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
কিন্তু এদেরকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে কোন মামলা হয়নি।

বিচার হওয়া উচিত’

মি. খান মনে করেন, সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন হওয়া উচিত তেমনি রাষ্ট্রীয় হেফাজতে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। যদি কোনটি হত্যাকাণ্ড হয় তাহলে সেটিও বিচার হওয়ার অধিকার রাখে।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগকে এর আগে প্রত্যাখ্যান করেছিল বাংলাদেশের সরকার।
এরপর এসব ঘটনা তদন্তের তেমন কোন উদ্যোগও দেখা যায়নি।
২০০৯ সালে ওই ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হয়েছিলেন যা পুরো দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
এ ঘটনায় হত্যা মামলার রায় হাইকোর্ট ঘোষণা করলেও সেটি এখনও সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলা এখনও আটকে আছে নিম্ন আদালতে। -বিবিসি

Related posts

Leave a Comment