রঞ্জুর ছেলেবেলা

-কাজী মোঃ হাসান

পর্ব-৪

রঞ্জু নিজের অপরাধটা টের পায়। তাই বকুনি ঝকুনি যা-ই ধিক কিছু গায়ে মাখে না। শুয়ে শুয়ে শুধু ব্যথায় নাকি কান্নার মতো গ্যানর গ্যানর শব্দ তুলে। আর দাদীর কোলে মুখ লুকিয়ে দাদুর রোষানল থেকে বাঁচার চেষ্টা করে।
দাদী, দাদুর কথা মতো হারিকেনটা আনতে যান মাচানের নীচ থেকে। সলতেটা সামান্য বাড়িয়ে বিছানার পাশে রেখে দেন সেটা। তার পর একটা কাপড়ের কুন্ডলি বানিয়ে হারিকেনের তাপে গরম করে রঞ্জুর কানে সেক দিতে লাগলেন উঠকন্ঠা নিয়ে।
এই করতে করতে ফজরের আযান পড়ে যায়। সকাল হতেই ছুটে আসেন সবাই। বড় চাচা, বড় চাচী, ছোট চাচা, ছোট চাচী, ফুফু এরা সবাই রঞ্জুর সেবা-শুশ্র“ষায় হাত লাগান। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। জ্বর এবং ব্যথা দু’টুই যন্ত্রণা দিয়ে গেলো একটানা- সেই আগের মতো।
ডাক্তার ডাকবে এমন সুযোগও নেই। ডাক্তার থাকলে তো ডাকবে? আশে-পাশের দু’তিনটা ইউনিয়নেও কোন ডাক্তার নেই। কেবল শুক্রবার হাটের দিন বঙ্গার বাজারে একজন ডাক্তার (পাশ করা না) অন্য জায়গা থেকে এসে রুগি দেখেন। হাট ভাঙ্গলেই আবার চলে যান তিনি। তাই কলেরা, বসন্ত, জ্বর বা সর্দ্দি যা-ই হোক- কবিরাজই একমাত্র ভরসা।
দাদু জরুরী কাজে ব্যস্ত থাকায় বিকেলের দিকে দাদী রঞ্জুকে নিয়ে গেলেন গায়েরই একজন কবিরাজের বাড়ি। লোকটা দাদুর কাছেই কবিরাজি শিখেছে। কবিরাজ মশাই রঞ্জুর কানটা নেড়েচেড়ে ভাল করে দেখলেন। তারপর পাশের আলমারি থেকে একটা চিমটা নামিয়ে আলতো করে রাখলেন প্লেটের উপর।
কানের ফোকরে একটু চোখ রেখেই কি যেন ভাবলেন কবিরাজ সাহেব। তার পর চোখে একটা মেগনিফাই গ্লাস লাগিয়ে চিমটা দিয়ে কানের ভেতরটা আরও ফাঁক করে টর্চ মেরে ভ্রু কুচকে বললেন-
– যা ভেবেছি তাই! ঐ তো, কান ভর্তি পানি। কানের পানি সরানো ছাড়া এ ব্যাথা কোন ভাবেই যাবে না।
– তা হলে পানি সরাবার ব্যবস্থা করুন। কিন্তু কি ভাবে? জানতে চাইলেন দাদী।
– কানে আগুনের নল ঢুকাতে হবে! এ ছাড়া কোন পথ নেই। বলতে বলতে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন কবিরাজ সাহেব।
কথা শুনে ভয়ে রঞ্জুর আত্মা খাঁচা ছাড়া। কানে আগুনের নল ঢুকাবে মানে? বলে কী বেটা! আগুন লাগলে কানটা কি থাকবে? একেই বলে হাতুড়ে কবিরাজ!
বিষয়টার গুরুত্ব বিবেচনা করে রঞ্জু দাদীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো-
: চলো দাদী, এখান থেকে চলে যাই। আমার ভীষণ ভয় ভয় করছে।
রঞ্জুর কথায় যাবার জন্য উঠা তো দূরের কথা, উল্টো মুচকি মুচকি হাসলেন দাদী। হাসি দেখে রঞ্জুর পিত্তি জ্বলে যায়-
: এখানে হাসির কী আছে? দাদীর কী! যত কষ্ট সব তো তাকেই ভোগ করতে হবে। মনে মনে কথাটা ভাবতেই আবার আব্দারের সুরে দাদীকে তাগাদা দিলো-
: চল না দাদী, এখান থেকে চলে যাই। লোকটা কিচ্ছু বুঝে না, কিচ্ছু জানে না। শুধু শুধু লোকে তাকে কবিরাজ বলে!এখানে দেখালে ভাল তো হবোই না, মাঝখান থেকে আমার কানটা যাবে!
আল্লাদ মাখা আদর দিয়ে রঞ্জুর কথার প্রতিবাদ করলেন দাদী-
: আরে বোকা! এখান থেকে চলে গেলে তোর কানের কী হবে? এই ব্যথা নিয়ে কদ্দিন থাকতে পারবি?
ব্যথাটা যে খুব বেশী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সহ্য করা সত্যি খুব কঠিন। কানের ব্যাথার কারণে গালটা পর্যন্ত ফুলে ঢোল। কিন্তু কী করবে- আগে জান, তার পর তো ব্যথা। রঞ্জু অনন্যোপায় হয়েই দাদীর আঁচল ধরে টানতে লাগলো-
: না, না! এই কবিরাজকে আমি দেখাবোই না। অন্য কবিরাজের কাছে চলো।
কিন্তু বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও দাদী রঞ্জুর কথায় কোন পাত্তাই দিলেন না। বরং তাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন টেবিলে-
: তুই চুপ করে এখানে বসতো! আগে তো দেখি, কবিরাজ সাহেব কী করেন!
তার পর কবিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন- ঠিক আছে, ওর কানের পানি খোলার ব্যবস্থা করুন।
কবিরাজ রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে পানি খোলার মালসামানা আনার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরে এলেন- হাতে জ্বলন্ত একটা কুপি, কিছু পরিষ্কার ন্যাকড়া, ছিদ্রিযুক্ত আধ হাত লম্বা একটা কাই নল এবং সামান্য কিছু সরিষার তেল নিয়ে।
ইতিমধ্যেই কবিরাজের কথাবার্তায় ভয়টা রঞ্জুকে চিপসে ধরেছে। এখান থেকে পালাতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু উপায় নেই! দাদী এই কবিরাজকে দেখাতেই যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাধ্য হয়ে বড় চোখ করে কবিরাজের কর্মকাণ্ড তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন গত্যন্তর রইলো না।
কবিরাজ সাহেব নলের এক মাথায় ন্যাকড়াটা পেঁচালেন খুব যত্ন করে। তারপর সূতা দিয়ে এমন শক্ত ভাবে বাঁধলেন যাতে ন্যাকড়াটা পড়ে না যায়। বাধা শেষ করে ন্যাকড়াটায় আগুন লাগিয়ে রঞ্জুর দিকে দ্রুত এগিয়ে দিয়ে বললেন-
– নাও, তারাতারি নলটা কানে ঢুকিয়ে দাও। রঞ্জু চিৎকার দিয়ে টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে বাধা দিতে যাবে, তার আগেই দাদীমা তাকে চেপে ধরে নলের আগুনের বিপরীত দিকটা কানের ছিদ্র পথে চেপে ধরলেন। রঞ্জু নিরুপায় হয়ে আবার টেবিলে বসে পড়লো চোখ বন্ধ করে! পরিবেশটা একটু শান্ত হতেই সে লক্ষ্য করলো-
আরে, এ তো ভীষণ মজার ব্যাপার! কানের ভেতর ভীষণ ফোঁস ফোঁস আওয়াজ- যেন বোঁ বোঁ শব্দে এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে। আওয়াজ শুনে যাদুর ছোঁয়ায় মতো রঞ্জুর মন থেকে ভয়টা এক মুহুর্তে হাওয়া। তাকে মনে মনে স্বীকার করতেই হলো- আসলেই সে একটা বোকা, নইলে শুধু শুধু কেউ এতো ভয় পায়?
কবিরাজ রঞ্জুর মাথাটা চেপে ধরে কানের পাশটা একটু মাটির দিকে কাত করে দিলেন। টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়তে লাগলো আগুনের ভেতর থেকে। সে ভেবেই পায় না- কানের ভেতর এতো পানি ঢুকলো কি ভাবে? আর এতোক্ষণ লুকিয়েই বা ছিলো কোথায়?
ফেরার সময় জ্বরটা সারার জন্য কবিরাজ সাহেব কিছু ঔষধ-পত্র দিলেন পুইরা বানিয়ে।
তার অসুখের খরবটা ইতিমধ্যেই রতন থেকে বাবলু, বাবলু থেকে জলিল, তার পর জগলুল, রবি, বাতেন সবার কাছেই পৌঁছে গেলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। বন্ধুকে দেখতে ছুটে এলো ওরা। কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকার সাহস নেই কারোর, দাদুর চোখে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না! তাই আওতা বেড়ার আড়াল থেকে উকি ঝুঁকি দিয়েই মনের দুঃখ মনে চেপে ফিরে গেলো সবাই।
পরদিন জ্বরটা একটু সারতেই রঞ্জু কিছুটা হালকা বোধ করতে লাগলো। সবার নিষেধ সত্ত্বেও একা একাই ঘর থেকে বের হয়ে হাটতে গেলো ছাড়াবাড়ির (খেলার মাঠের মতো) দিকে। খোলা জায়গা। বেশ ভালোই লাগছিলো হাটতে। টেলিপেথির মাধ্যমে খবর পেয়ে বন্ধুরাও এসে হাজির। হাবিব খুশিতে রঞ্জুর পিঠে একটা থাপ্পর মেরে উল্লাসে চিৎকার করতে করতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো গায়ের উপর-
: কি রে এখন কেমন আছিস?
: ভালো!
: যাক, ভালো হলেই ভালো! মুরুব্বিদের মতো গলার স্বরটা গম্ভীর করে উত্তর দিলো হাবিব। তারপর বসে পড়লো একটা ফাঁকা জায়গায়।
সবাই বসলো গোল হয়ে। বসলো দুব্বা ঘাসের উপর। আড্ডা দিলো একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিষয় একটাই- রঞ্জুর অসুখ। রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গেলো জ্বরটা নিয়ে। কেন জ্বর এলো, কি ভাবে কানে পানি গেলো- এমনি হাজার রকম প্রশ্ন। অথবা কবিরাজের কাছে না গেলে তার আর কী কী হতে পারেতো সেটাও ভেবে দেখলো সভাসদরা। নিজের মতটাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোটখাটো তর্কাকর্তীও হয়ে গেলো নিজেদের মধ্যে।
এদিকে কোত্থেকে ছুটে এসে বসতে না বসতেই রিন্টু বিজ্ঞের মতো কমেন্ট ছুড়ে মারলো রঞ্জুর দিকে-
: এই যে রঞ্জু, তুই আসলেই একটা বোকা। এভাবে কেউ পানিতে ড্রাইভ দেয়? সাঁকো থেকে লাফিয়ে পড়ার আগে কানের ভেতর আঙ্গুল দিয়ে নিলেই তো হতো, পানি ঢুকা তো দূরের কথা- তার বাবাও ঢুকতে পারতো না।
রিন্টুর কথা শুনে বাবুল আর চুপ করে থাকতে পারলো না। উল্টো জ্ঞান দিলো ধমকের সুরে-
: থাম তুই! কিছু বুঝিস গাধা, কানে আঙ্গুল দিয়ে লাফ দেয়া যায়? তুই দিয়েছিস কোন দিন? হাত খোলা না থাকলে পানির ভেতর থেকে উঠবে কী ভাবে? পানির ভেতর থেকে উপরে উঠতে গেলে হাত দিয়ে যে পানি কাটতে হয়, সেটা জানিস তুই? মুর্খ কোথাকার!
কথার যেন শেষ নেই। বিজ্ঞজনদের এ সভায় সমস্যা ও সমাধানগুলো বিস্তারিত ভাবে আলোচনা হলো ঠিকই কিন্তু ফালাফল সেই শূন্য। আগেও কোনদিন হয়নি, আজও হলো না। আলোচনা অবস্থায়ই সভা মুনতবী করে পরস্পরের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো একে একে। (চলবে———)

 

Related posts

Leave a Comment