সাদা ঘোড়া

-কাজী মোঃ হাসান

কয়েক দিন পর। আব্বুর কাছে মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরে দু’ভাই। কিন্তু বায়না ধরলেই তো আর হয় না, বাড়িতে মিষ্টি কোথায়? আগে বাজার থেকে আনতে হবে, তারপর মিষ্টি খাওয়া। তাই পরদিনই রঞ্জু আব্বুর সাইকেলের সামনের হেন্ডেলে চড়ে বাজারে গেলো মিষ্টি কিনতে।
বাজারে মহাদেব ঘোষের মিষ্টিই সেরা। দোকানে ঢুকতেই এক প্লেট মিষ্টি এনে দিলেন মহাদেব ঘোষ নিজে। রঞ্জু এক বসাতেই টপাটপ গিলে ফেলে তিনটা রসগোল্লা। আর এতেই পেট ভরে একধম ঠাসা। মহাদেব ঘোষ আরও কয়েকটা চমচম ও সন্দেশ এনে দিলেন। কিন্তু রঞ্জুর পক্ষে আর কিছু খাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু সবার চাপাচাপিতে একটা চমচম আর একটা ছানার সন্দেশ খেতেই হলো তাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এক হাড়ি মিষ্টি কিনে নিলো বাড়ির জন্য।
এবার পাড়ি ফেরার পালা। রঞ্জুর একার পক্ষে বাড়ি ফেরা অসম্ভব। তাই রঞ্জুদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে, এমন একজন পরিচিত লোকের সঙ্গী করে দিলেন আব্বু। তিনি নিজেই যেতেন, কিন্তু একজন সিরিয়াস রোগী আসায় যেতে পারলেন না। রঞ্জুদের বাড়িটা বেশী দূর না, বাজার থেকে নেমে একটু দক্ষিণ দিকে গেলেই রাস্তার ডান দিকে বটতলা এবং রাস্তার বাম দিকে বিশাল জায়গা জুড়ে থানার অবস্থান। আর একটু গলেই বড় মঠ। তার পেছনেই বাড়িটা। মঠের মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালেই রঞ্জুদের বাড়িটা দেখা যায়।
দু’জনে কথা বলতে বলতে হেটে বাজার ছেড়ে বট তলায় আসতেই দেখে, তার বয়সি একটা ছেলে বিপরীত দিক থেকে দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছে। ভাবখানা এমন, যেন লর্ড ক্লাইভ আসছেন। হাতে লম্বা লিক লিকে বেত। মাথায় সাহেবি টুপি। বেতটা বাতাসে ঘুরাচ্ছে ভনভন করে।
দলটা, রঞ্জুদের ঠিক সামনের একটা ছেলের কাছে এসে থামে। ঘিরে ধরে তাকে। ছোট জটলা। কিছু বুঝার আগেই হঠাৎ লর্ড ক্লাইভ বেতটা দিয়ে বে-ধড়ক পেটাতে শুরু করে ছেলেটাকে। যেন চোর পেটাচ্ছে। অচমকা আক্রমনে ছেলেটাও দিশেহারা। নিরুপায় হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে উর্ধ্বশ্বাসে লাফালাফি আর চিৎকার শুরু করে ছেলেটা!
ঘটনাটা ঘটে মুহুর্তের মধ্যে। কিন্তু কারা পেটাচ্ছে, কেন পেটাচ্ছে- কিছুই বুঝার উপায় নেই। ঘটনার আকষ্মিকতায় সবাই থ। তাই ছেলেটাকে রক্ষায় এগিয়ে আসার সুযোগই পায়নি কেউ।
ঘোরটা কাটতেই সবার আগে ছুটে যায় রঞ্জু। লর্ড ক্লাইকে জাপটে ধরে বেতটা কেড়ে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। বাঁধা পেয়ে ক্ষেপে যায় ক্লাইভ সাহেব। ছেলেটাকে ছেড়ে এবার রঞ্জুকেই মারতে শুরু করে সে। সপাং সপাং বেত মারতে থাকে রঞ্জুর মাথায়। আচমকা আঘাত সহ্য করা রঞ্জুর জন্য সত্যি খুব কঠিন। ঘুরে যায় তার মাথাটা। পড়ে যাবার অবস্থা। প্রত্যেকটা আঘাতের জায়গা ফুলে ঢোল।
কিন্তু ছেলেটা কে?কে এই লর্ড ক্লাইব?
এবার আশপাশ থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন মুরুব্বিরা। বিপদ দেখে ক্লাউভের সঙ্গীরা ভোঁ দৌড়। সোজা থানার দিকে। তার পর দশ-পনেরো মিনিটও গেলো না, তিনজন পুলিশ ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। এসেই চোখ রাঙ্গিয়ে, গালাগাল দিয়ে, রঞ্জুকে ধরে থানার দিকে চললো হনহন করে। ব্যাপার দেখে তীব্র প্রতিবাদ করে আশপাশের লোকজন-
: আরে! আরে! আপনারা ওকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?
কিন্তু কে শুনে কার কথা? তারা শান্তি বাহিনীর লোক। শান্তি রক্ষার স্বার্থে যা ভালো মনে হয় তা-ই করেন। তাদের অভিযোগ- এই ছেলেটা, ওসি সাহেবের ছেলেকে মেরেছে। এটা মারাত্মক অপরাধ। তাই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই!
পুলিশের অভিযোগ শুনে রঞ্জু থ-
: বলে কি পুলিশেরা!
দূর থেকে ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করছিলেন যারা, তারাও অবাক! তাই পুলিশের কাজে বাঁধা দিলেন সবাই। কাজ হলো না। বাঁধা সত্ত্বেও জোর করেই রঞ্জুকে থানায় নিয়ে গেলো তারা। উপস্থিত জনতাও তাদের সঙ্গে থানায় গিয়ে হাজির।
তখন থানা কমপ্লেক্সের বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিলেন দারোগা সাহেব। হাবভাব দেখে মনে হলো, তিনি যেন তাদের অপেক্ষাতেই এতোক্ষণ বসে ছিলেন। রঞ্জুকে দেখা মাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে সিংহের মতো হুঙ্কার ছেড়ে এগিয়ে এলেন তিনি-
: আমার ছেলেকে মারতে পারে এমন সাহস কার? দেখি তো ছেলেটা কে?
আরো দু’পা এগিয়ে একদম রঞ্জুর মুখুমুখি। রাগে কাঁপতে কাঁপতে রঞ্জুর দিকে আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞেস করলেন-
: এই ছোকরা, তুই কি আমার ছেলের গায়ে হাত তুলেছিস?
রঞ্জুর জীবনে এমন পরিস্থিতি আর আসেনি। উত্তরে সে কি বলবে না বলবে- কিছুই ভাবতে পারছে না। তবে এটা ঠিক, কিছু না বলার মানেই হলো অন্যায়কে মেনে নেয়া। তাই আল্লাকে স্মরণ করে দারোগা সাহেবের কথার প্রতিবাদ করে অত্যন্ত ভদ্রভাবে –
: আমরা কেউ আপনার ছেলেকে মারিনি। বরং আপনার ছেলেই আমাদের মেরেছে।
রঞ্জুর কথার সমর্থনে গায়ের জামা খুলে মারের চিহ্নগুলো দেখালেন মুরুব্বিরা। কিন্তু তিনি সে দিকে ফিরেও তাকালেন না। কেন তাকাবেন? তিনি হলেন দারোগা সাহেব। থানার বড় কর্তা। কারো কথা শুনা বা কারো কথায় পাত্তা দেয়া তার কাজ নয়। নিজে যা বুঝেন, যা দেখেন, সেটাই চুড়ান্ত। দারোগা সাহেবের ছেলের কাজে বাঁধা দেয়াটাই বড় অপরাধ। এর চেয়ে বেশী আর কি চাই? কাজেই, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন তিনি-
: নিশ্চয়ই তোরা অন্যায় করেছিস, না হলে আমার ছেলে মিছেমিছি তোদের মারতে যাবে কেন?
তর্ক করা রঞ্জুর কাজ নয়। তাই বলে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করাও অন্যায়। আব্বু তো তাদের তাই শিখিয়েছেন। সুতরাং দৃঢ় কন্ঠে দারোগা সাহেবের কথার প্রতিবাদ করলো সে-
: নিশ্চয়ই না। আমরা কোন অন্যায় করিনি। তাকে মারতেও যাইনি।
রঞ্জুর লক্ষ্য করেছে, লোকটার ধমকের কাছে সবাই যেনো কাচুমাচু। আসলে লোকটা যে কে- ঠিক জানেনা। থাক বাবা, এতো জেনেশুনে কাজ নেই। এ মুহুর্তে তার মাথায় একটাই চিন্তা- যা হবার হবে, সত্য কথা তাকে বলতেই হবে।
সব শুনেও দারোগা সাহেবের মেজাজ টং। কন্ঠস্বরটা আগের মতো তুঙ্গে রেখেই বললেন-
: সে যদি মেরেই থাকে, তোরা আমার কাছে না এসে তাকে আটকাতে গেলি কেন?
রঞ্জুর একই উত্তর-
: আমি তাকে আটকাইনি। শুধু ছেলেটাকে মারতে বাঁধা দিয়েছি।
কথাটা সত্য কি মিথ্যা সেদিকেই গেলেন না দারোগা সাহেব। বরং হাতের কলমটা ঘুরাতে ঘুরাতে রঞ্জুর নাকের ডগায় এসে জিজ্ঞেস করলেন-
তোর নাম কী রে ছোকরা? তোর বাবা কে? বাড়ি কোথায়? এতো সাহস তোর- মুখে মুখে তর্ক করিস। বেয়াদপ কোথাকার!
গালাগালির সাথে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে মাঠ গরম করে তুললেন তিনি।
মাঠ যতই গরম হোক, রঞ্জুর তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। সে কোন অন্যায় করেনি। কাজেই মাথা নীচু করার কোন প্রশ্নই আসে না!
: আমার নাম রঞ্জু। ডাক্তার আবদুর রহমান সাহেবের ছেলে আমি। বাড়ি কাছেই- শিবপুর।
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনেই দারোগা সাহেব একটু দম নিলেন। তাঁকে খুব ভালো ভাবেই চেনেন তিনি।
গুম হয়ে কিছুক্ষণ রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। এবার পায়ের উপর পা তুলে নাড়াতে নাড়াতে কলমটা দিয়ে কাঠ ঠোকরা পাখির মতো ঠক ঠক আওয়াজ তুললেন টেবিলের উপর। আড়চোখে সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে টেবিলের উপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে এক শলা ধরালেন।
এদিকে রঞ্জুর আব্বু কার কাছে কি শুনেছেন কে জানে, হন্ত-দন্ত হয়ে থানায় এসে হাজির। সাথে আরও আট-দশজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তি এবং বাজারের লোক। ইতিমধ্যে বাজারে আসা উৎসুক পথচারীদের অনেকেই ভীড় করেছেন থানা চত্তরে।
এবার প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের কথা শুনতে বাধ্য হলেন তিনি। কিন্তু সব শুনেও চুপচাপ। যেন কিছুই শুনতে পাননি।
জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেলো, দারোগা সাহেবের ছেলে তার বাবাকে চোর পেটাতে দেখেছে বহুবার। ধীরে ধীরে তার মনেও চোর পেটাবার শখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। কিন্তু চোর পাবে কোথায়? দিন যত যায়, লালিত বাসনাটা ততই ফেনিয়ে ওঠে কাল সাপের মতো। হঠাৎ করেই সেদিন ওসি সাহেবের বেতটা চুরি করার সুযোগ পেয়ে সরিয়ে নেয় সেটা। একটু পরেই বেতটা নিয়ে বেরিয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। হাটতে হাটতে বট তলায় আসতেই সামনে পড়ে ছেলেটা। কোন কিছু না ভেবেই বেত চালিয়ে দেয় তার উপর।
এতকিছু সত্ত্বেও দারোগা সাহেব তার ছেলের কোন দোষ খুঁজে পেলেন না। সুতরাং বিচার করবেন কার? উল্টো ছেলের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করেন বিভিন্ন অজুহাত তুলে।
বিচার না পেয়ে এক সময় রঞ্জুর আব্বু সবাইকে নিয়ে ফিরে আসেন বাসায়। এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে। কথাটা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে এম.এন.এ কানে উঠে। তার দরবার ঘুরে কথাটা পৌঁছে যায় এস.ডিও সাহেবের কাছে। শেষে পর্যন্ত সর্বোচ্চ মহলে। পরিণতিতে, এক মাসের মধ্যেই দারোগা সাহেবের বান্দরবান বদলী।
দারোগা সাহেব তো বদলী হয়েই খালাস। এদিকে রঞ্জুর অবস্থা আরও কাহিল। কার্যত নজরবন্ধী। দূরবীনের মতো এক ঝাঁক চোখ সারাক্ষণ সার্চ লাইট ফেলে আগলে রাখছে তাকে। সে কোথায় যায়, কখন যায়, কার কাছে যায়, কার সঙ্গে খেলে- সব কিছুতেই নজরদারি। বিপদ আর কাকে বলে! স্বাধীনতার বারটা। মাকে ফাঁকি দিয়ে এখানে সেখানে একটু গেলেও ধরা পড়ছে প্রতিবার । কাজেই ঘুরাফেরা একদম বন্ধ!
এই গেলো রোববারের কথাই ধরি। চারদিকে কাঠফাঁটা রোদ্দোর। গরমে খেলাটা তেমন জমছিলো না। সুতরাং খেলা বন্ধ করে সবাই ছুটলো পালপাড়ার পুকুর ঘাটে। ইচ্ছে, মনের সুখে লুটিয়ে-পুটিয়ে কিছুক্ষণ গোসল করা।
পুকুরটাও বিরাট। জমিদারদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সুধীর পাল বাড়ির সামনে এটা কেটেছিলেন। পুকুরের উত্তর ও পশ্চিম দিকে শান বাঁধানো ঘাট। উত্তর ঘাটের সিড়িগুলো এখনো প্রায় অক্ষত। কিন্তু পশ্চিম ঘাটের অবস্থাটা বেশ নড়বড়ে। কয়েকটা সিড়ি ভাঙ্গা। সবুজ শ্যাওলা পড়েছে ভাঙ্গা সিড়ির ফাঁকে ফাঁকে। পানির নীচের প্রথম সিড়িটাতে শ্যাওলা থাকায় বেশ পিচ্ছিল। একটু এদিক সেদিক হলেই পা পিছলে ধপাস।
রঞ্জুরা উত্তর ঘাট দিয়ে পুকুরে নেমে শরীরটা ভিজিয়েছে মাত্র। ঠিক তখনি, কোত্থেকে একজন বয়স্ক লোক গোসল করতে এলেন। কাঁধে গামছা। লোকটা অপরিচিত। হাতে পেতলের ঘটি। মাথায় টিকি। কপালে নাকের গোড়া থেকে মাথার চুলের সিঁথি পর্যন্ত সাদা তিলক। তিনি সিড়ির উপর হাতের ঘটিটা রেখে পানিতে পাদু’টো ডুবিয়ে একটু ঘষলেন। তার পর সিড়ির উপর পা তুলে গোড়ালিগুলো ঘষতে লাগলেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
ঘষাঘষি শেষ করে হরহরিয়ে নেমে গেলেন পানিতে। কোমড় পানিতে নেমে নাভির গোড়ায় হাতের পিতলের ঘটিটা দিয়ে কয়েক ঘটি পানি ঢাললেন নাভির গোড়ায়। তারপর এক ডুব। অনেকক্ষণ কাটালেন এক ডুবে। ডুব থেকে উঠে গামছায় গতর ঘষে আবার ডুব। এবার খুব ঘনঘন। একের পর এক- কোন দম না ফেলে। মনে হলো, তিনি যেন গুণে গুণে ডুব দিচ্ছেন, যাতে একটাও কম-বেশী না হয়। ডুবের পর গলার পৈতায় হাত বুলিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন অনুচ্চ স্বরে। তারপর মাথার উপর দিয়ে পেছন দিকে পানি ছিটিয়ে দিলেন কয়েকবার। কতবার পানি ছিটিয়েছেন- রঞ্জু গুণে দেখেনি। পাঁচ-ছ’বার তো হবেই, হয়তো আরও বেশী! এ কাজ শেষ হতেই সূর্যের দিকে মুখ করে প্রণাম করলেন সূর্যকে।
গোসল শেষ। এবার হাত দিয়ে পানি ঠেলতে ঠেলতে সিড়ির উপর উঠে এলেন তিনি। পানি থেকে একধাপ উপরের সিড়িতে দাঁড়িয়ে গামছাটা চিপে হাতের তালুতে ‘পটাশ’ শব্দে একটা বাড়ী দিয়ে বাতাসে ঝারা দিলেন একটা। এবার গা মুছতে লাগলেন সেই গামছা দিয়ে। হঠাৎ তার চোখ যায় রঞ্জুর উপর। যেন ভুত দেখছেন। চোখ কপালে তুলে জানতে চাইলেন-
; এই ছোকরা, তুমি ডাক্তার সাহেবের ছেলে না?
: হ্যাঁ। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে রঞ্জু। সঙ্গে সঙ্গে যেন বাজ পড়ে লোকটার মাথায়-
: তুমি এদের সঙ্গে মিলে দুষ্টুমি করছো? না না, এ-তো ভালো কথা নয়! যাও, শিগগির উঠে পড়। ডুবাডুবি অনেক হয়েছে, আর না। নির্ঘাত জ্বর সর্দি বাধিয়ে বসবে। এবার বাড়ি যাও। নয়তো তোমার বাবাকে বলবো।
তাকে চেনে না, জানে না- কোথাকার কোন লোক, মাতাব্বরি খলাচ্ছে! রাগে শরীরটা খিঁচিয়ে ওঠে রঞ্জুর। বলি, এত অত্যাচার কি সহ্য হয়, না কেউ করে? কিন্তু কোন উপায় নেই! সত্যি সত্যি যদি আব্বুকে বলে দেন তা হলে আর রক্ষে থাকবে না! সুতরাং ভয়ে ভয়ে কোনমতে গোসল শেষ করে ভদ্র ছেলের মতো বাড়ির পথ ধরলো।
শুধু এটাই নয়! খেলার মাঠে, বাজারে, কিংবা বিলে মাছ ধরতে গেলে- এক কথায় যেখানেই যায়, কেউ না কেউ তার উপর খবরদারী করছেই। এতো খবরদারী, এতো শাসন আর ভালো লাগে না! সত্যি, দিনকে দিন সব কিছু যেন অসহ্য হয়ে উঠছে! এ ভাবে আর কতদিন চলবে- কে জানে! মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে রঞ্জু-
: ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাকে রক্ষা করো!
নতুন যে দারোগা সাহেব এসেছেন, তাঁর আবার ঘোড়ায় চড়ার সখ। এ ছাড়া কোন উপায়ও নেই? গ্রামের রাস্তা-ঘাট ভীষণ দুর্গম আর ভাঙ্গাচোরা। ক্ষেতের আলগুলো আঁকা বাঁকা এবং চিকন। মাঝে মাঝে এতোটাই চিকন যে পায়ে হাটাই কষ্টকর। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে যেতে হলে সাইকেল থেকেই দু’তিন বার নামতে হয়। এ অবস্থায় ঘোড়ায় না চড়ে উপায় কি?
দারোগা সাহেব এখানে এসেই ঘোড়াটা কিনলেন। দেখতে নাদুস-নুদুস, বেশ তাগড়া। রংটা একদম সাদা। শুধু মাথার মাঝখানে সামান্য লাল। ঘাড়ের চুলগুলো গলার নীচ পর্যন্ত ঝুলানো। ঘোড়াটার দেখাশুনার দায়িত্ব দিলেন দেশ থেকে আনা আবুলকে। খুব চটপটে জোয়ান ছেলে।
একদিন থানা কমপ্লেক্সের বারান্দায় বসে বন্ধু-বান্ধব ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন তিনি। কথায় কথায় খুব তারিফ শুরু করলেন ঘোড়াটার। যাকে বলে উচ্ছসিত প্রশংসা। তাঁর খুব ইচ্ছে ঘোড়াটার বাহাদুরি সবাইকে দেখান। এ জন্য চা খাওয়ার এক পর্যায়ে সহিস আবুলকে ডেকে বললেন-
: আবুল, এই আবুল, ঘোড়াটা নিয়ে যা। লতবদীর কাছ থেকে পশ্চিমের চক দিয়ে দৌড়িয়ে থানা পর্যন্ত নিয়ে আয়। দেখি কেমন দৌড়াতে পারে! চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ের রাস্তাটাও দেখিয়ে দিলেন ইশারা করে।
দৌড়ের থল্লাটা বেশ ঝামেলার। লতবদী কাছ থেকে পোয়া মাইলের মতো সবটাই হাল চষা ইটা ক্ষেত। পরের কিছু অংশ ডিষ্টিকবোর্ডের রাস্তা। তবে খুব চিকন। বড়জোড় দুই তিন হাত প্রসস্থ। আধা মাইল আসার পর বড় রাস্তা। এটা আবার বেশ উঁচু। অস্তত এক হাত তো হবেই। এ পথেই থানায় ফিরে আসা। রাস্তার এই উচু-নীচু, উঠা-নামা দৌড়ের জন্য খুব কষ্টকর। বিশেষ করে সহিসের জন্য।এই চড়াই উতরাই করার সময় ঘোড়ার পিঠে টিকে থাকাই বেশ কষ্টের। তবে সুবিধা-অসুবিধা যা-ই থাক, দৌড় দেখে সবাই খুব সন্তুষ্ট। ঘোড়াটা সাঙ্গাতিক তেজি!
কয়েক মাস যেতে না যেতেই এক ঘোড়ার দৌড় দেখতে দেখতে হাফিয়ে উঠলেন দারোগা সাহেব। তা ছাড়া বন্ধু-বান্ধবরা ইতিমধ্যেই নতুন আর একটা ঘোড়া কেনার জন্য তাগাদা শুরু করেছেন। সেদিন চায়ের আড্ডায় স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেব কথাটা তুললেন এভাবে-
: ওসি সাহেব, আর একটা ঘোড়া কিনেন। প্রতিযোগিতা না থাকলে কী কোন কিছুতে আনন্দ আছে?
কথাটা একদম ঠিক। প্রতিযোগিতা না থাকলে কোন কিছুতেই আনন্দ নেই। স্থির করলেন- আর একটা ঘোড়া কিনবেন। মাস না যেতেই কিনেও ফেললেন। কেনার সময় সঙ্গে নিলেন সোনার গাঁ থানার দারোগা সাহেবকে। খুব সমঝদার লোক। পছন্দ করার জন্য অত্যস্ত সহযোগী ।
নতুন ঘোড়াটাও বেশ তাজা। গায়ের রংটা একটু বাদামি। তবে আমরা এটাকে লালই বলে থাকি। দুলকি চালে চলার সময় ঘাড়ের চুলগুলো হেলেদুলে ঝর্ণার স্রোতের মতো ঢেউ তুলে নাচে।
এটার দেখাশুনার দায়িত্ব দিলেন পাশের গাঁয়ের ভবঘুরে হযরত আলীর উপর। ছেলেটা ভবঘুরে হলে কী হবে, ভীষণ চটপটে আর কাজের। অল্প ক’দিনেই খাইয়ে-দাইয়ে ঘোড়াটাকে তেলতেলে এবং তাগড়া করে ফেললো সে। সারাক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে থাকে ঘোড়াটা। আজকাল একসঙ্গে দু’টোকেই দৌড়ের জন্য পাঠানো হয়। আর দারোগা সাহেব শেষ বিকেলে চা-সিগারেট খেতে খেতে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থানা কমপ্লেক্সের বারান্দায় বসে তা-ই দেখেন।
যতবার দৌড় হয়- ততবারই জয়ী হযরত আলীর লাল ঘোড়াটা।
দিনকে দিন ঘোড়ার দৌড়টা বেশ জমে উঠে। খবরটা ছড়িয়ে যায় আশেপাশের গ্রামগুলোতে। ইদানিং গ্রামের লোকজনও জড়ো হয় ঘোড়-দৌড় দেখার জন্য। রঞ্জুরা তো বিকাল হলেই ডিক্ট্রিকবোর্ডের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করে কখন দৌড় শুরু হবে।
স্বাধীনতা দিবসের দিন। উৎসবের পাশাপাশি সারাদিন চলে বক্তৃতা এবং সেমিনার। পাশপাশি খেলাধুলার অনেক আয়োজন। বিকেলের শেষ খেলা- ঘোড়-দৗড়। দারোগা সাহেবের ঘোড়া তো আছেই, খেলায় অংশ নিতে আশপাশের গ্রাম থেকেও কয়েকটা ঘোড়া আসে। ঘোড়া নিয়ে থল্লার দিকে যাবে এমন সময় দারোগা সাহেবের মাথায় কি ঢুকলো কে জানে- তিনি ঘোড়ার সহিস পাল্টে দিলেন। হযরত আলীকে দিলেন সাদা আর আবুলকে দিলেন লাল ঘোড়াটা। সুতরাং আজকের দৌড়টা সম্পূর্ণ অন্য রকম।
সবাই জানে, সাদা ঘোড়াটা বেশী দৌড়াতে পারে না। তবে অন্যগুলো যে সাদা ঘোড়াটার সঙ্গেও পারবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে ভাবনা হলো লাল ঘোড়াটা নিয়ে। সব সময় এটাই তো জেতে! আজও যদি জিতে যায় তা হলে এলাকার মান ইজ্জতে বিরাট ধাক্কা। সাদা ঘোড়া নিয়ে হযরত আলী যে কী করবে সেটাই দেখার বিষয়। এটা হযরত আলীর জন্য যেমন চ্যলেঞ্জ, এলাকার জন্যও তাই! অন্ততঃ রঞ্জুরা তাই মনে করে।
দেখতে দেখতেই দৌড় শুরু। আগের মতো লাল ঘোড়াটাই থাকে এগিয়ে। তার পেছনে সাদাটা। অন্যান্যগুলোর কোন পাত্তাই নেই। একের পর এক জমি পার হয়ে দ্রুত বেগে ছুটছে ঘোড়া দু’টো। জমির পর চিকন রাস্তাটাও প্রায় শেষ। বড় এবং উচু ডিষ্ট্রিক বোর্ডের রাস্তাটা ধর ধর। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জুরা।
দারোগা সাহেবের ঘোড়া দু’টো বড় রাস্তায় লাফ দিয়ে উঠার সময় হঠাৎ করেই ঘটনাটা ঘটে। সাদা ঘোড়াটা লঙ্খীরাজের মতো এক লাফে টপকে যায় লাল ঘোড়াটাকে। ব্যাপারটা অলৌকিক এবং অবিশ্বাস্য! সবাই হতবাক! শেষ পর্যন্ত কারো কিছু বুঝার আগেই সাদা ঘোড়াটা পৌঁছে যায় সীমানার শেষ প্রান্তে। খুশীতে চিৎকার করে ঘোড়ার উপর থেকে লাফিয়ে মাটিতে নামে হযরত আলী।সত্যি, সাদা ঘোড়াটার এ জয় অকল্পনীয়। উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন দারোগা সাহেব। আবেগে ছুটে গিয়ে বিজয়ী ঘোড়াটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হযরত আলীর পিঠে চাপড় মেরে সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে বাহবা দিলেন অসম্ভব এক তৃপ্তি নিয়ে-
: বাপরে বাপ, তুই তো মারাত্মক যাদু জানিস রে আলী! কি করে এমনটা করলি?
প্রশংসা শুনে গদগদ হয়ে দারোগা সাহেবকে সালাম করে দোয়া চাইলেন হযরত আলী-
: সবই আপনার দোয়া স্যার!
(চলবে……………)
(“রঞ্জুর ছেলেবেলা”- থেকে)

Related posts

Leave a Comment