নৌকা বাইশ

-কাজী মোঃ হাসান

প্রতি বছর ভাদ্র মাসের পয়লা তারিখে নৌকা বাইশ (বাইচ) হয় রঞ্জুদের বাড়ির সামনের নদীটায়। এবারও তার প্রস্তুতি চলছে পুরুদমে। শুনা যায়- কালাপাহাড়িয়া, কদমীরচর, বৈদ্যারবাজার, নবীনগর, শ্রীমদীর ওপার থেকেও বাইশের নৌকা আসবে। তবে যত নৌকাই আসুক খাগকান্দার ধনু বেপারীর নৌকার সঙ্গে এ পর্যন্ত কেউ পারেনি, সামনেও কেউ পারবে বলে মনে হয় না।
বেপারীর নৌকাটা লম্বায় ত্রিশ হাত এবং পাশে (প্রস্তে) পাঁচ হাত। সেগুন কাঠের তৈরী। মোট মাল্লা পঁত্রিশ জন। আড়িতে থাকেন তিন জন। মেইন আড়িতে গঞ্জর আলী। একদম সামনের গলুইয়ে বসে বৈঠা টানেন মন্টুর বাপ ফালাইন্যা। এ ছাড়া গুড়ার দুই পাশে বসে দাঁড় টানেন অন্যান্য মাঝিরা। মাঝেখানে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে সারিন্দা, ঢাক, ঢোল, বাঁশি, করতাল ইত্যাদি নিয়ে তৈরী থাকেন গেন্দু বয়াতির দল। বৈঠার তালে তালে গান গেয়ে তারা মাল্লাদের উৎসাহ দেন। গত পাঁচ বছর ধরে এই সেটের কোন ব্যতিক্রম হয়নি। প্রত্যেকের আসনটা যেন ছাপ্পর মারা।
এবার সেই ধনু বেপারীর নৌকাকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই আসছে অন্যান্যরা।
সাত দিন আগেই ধনু বেপারী নৌকাটা ডাঙ্গায় তুলে টুকটাক মেরামতের কাজ শেষ করলেন অনেক যত্ন নিয়ে। প্রথমে গাবের সঙ্গে কুড়া মিশিয়ে নায়ে লাগালেন, পরে আলকাতরা লাগিয়ে ভালো ভাবে শুকিয়ে তকতক ঝকঝক- বলতে গেলে একদম নতুন করে ফেললেন এটাকে।
রঞ্জুরা সবাই মিলে নৌকাটা দেখতে গেলাে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে। কী পালিশ! হাত রাখলে আপনাতেই গড়িয়ে পড়ে।
বাইশের দিন দুপুরের পর পরই জেঠাজীর সঙ্গে বেরিয়ে যায় রঞ্জুরা। এবার নৌকা এসেছে মোট পঁচিশটা। কাশিমপুর টু জলথানা পর্যন্ত এক মাইল থল্লা।
শুরুটা কাশিমপুর থেকে। সেখানে গিয়েই জড়ো হলো সব নৌকা। কদমীর চরের নৌকটা বেশ বড়- ত্রিশ হাতের মতো। তারচাইতে বড় নবীনগরের নৌকাটা। এটা লম্বায় পঁয়ত্রিশ হাত। প্রত্যেকটা নৌকাই রঙ্গীন কাগজের নিশান দিয়ে সাজানো।
বাইশ শুরুর প্রস্তুতি চূড়ান্ত। নদীর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত টানা সূতার সামনে পাশিপাশি সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে যায় নৌকাগুলো। এবার বাঁশির অপেক্ষায় কান খাড়া রেখে প্রহর গুণছে সবাই। বাঁশি বাজানোর দায়িত্বটা জেঠাজীর হাতে। ঠিক তিনটা এক মিনিটে বাঁশি বাজিয়ে দিলেন তিনি।
আমাদের অবস্থান থল্লার মাঝামাঝি জায়গায়। জেঠাজী আগে থেকেই স্থান ঠিক করে দিয়েছিলেন সেখানে। এ জায়গা থেকে বাইশের শুরু এবং শেষটা স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়।
ফাটাফাটি লড়াই। নবীনগরের নৌকাটা শুরু থেকেই এগিয়ে। তার পিছনে ধনু বেপারীর নৌকা। এক সময় টেক্কা মারে কালাপাহাড়িয়ার নৌকাটা। সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় বিদ্যুৎ গতিতে। তবে, আসল লড়াইটা শুরু হয় পোয়া মাইল থাকতে। এখানে এসেই ধনু বেপারীর নৌকাটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে। ছুটতে থাকে চিতা বাঘের মতো। এদের কাছে নৌকা বাইশ শুধু বিনোদনই নয়। চেম্পিয়ান হওয়ার আকাঙ্খাটাও ভীষণ তীব্র। জান তাকা আর যাক- তাদের জিততেই হবে। হয়তো এ জন্যই তাদের সঙ্গে কেউ পারেনা।
তীব্র উত্তেজনা। নদীতে ঢেউয়ের প্রচণ্ড দাপট। ইতিমধেই ঢেউয়ের ধাক্কায় ডুবে গেছে ছোট্ট একটা কোশা নাও। এটার উদ্ধারে একযোগে এগিয়ে এলো আশপাশের সবাই। ধরাধরি করে তুলে নিলো যাত্রীদের। তবে সবার মাঝে ভাবখানা এমন যেন এটা কিছুই না- নৌকা বাইশ দেখতে এলে এমনটা হবেই! বরং এটা না হলেই যেন নিয়মটা ভঙ্গ হয়, খেলাটা জমে না!
ইতিমধ্যে সব নৌকা সীমানার একদম কাছাকাছি চলে আসে। রশিটা ছুঁই ছুঁই করছে। চরম উত্তেজনা। চূড়ান্ত ফলাফল দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। শেষ পর্যন্ত রঞ্জুদের অনুমানই সত্য হয়। ধনু বেপারীর নৌকাটাই ছিনিয়ে নিলো জয়ের শিরোপা। মাত্র এক মিনিটের ব্যবধান।
ছোটখাট বক্তৃতার পর চেয়ারম্যান দাদু প্রাইজ হিসেবে “সিল্ড” বিতরণ করলেন বিজয়ীদের মধ্যে। ফাষ্ট, সেকেণ্ড এবং থার্ড -এই তিন জন পেলেন সিল্ড। ফাষ্ট হওয়ার জন্য খুব বড় সিল্ডটা পেলান ধনু বেপারী। একটু ছোট সিল্ডটা পেলেন সেকেণ্ড হওয়া নবীনগরের প্রধান। আর তার চেয়ে ছাট সিল্ডটা দেয়া হলো কালাপাহাড়িয়ার লতিফ মোল্লাকে। অংশ গ্র্র্রহনের জন্য বাকিরা পেলেন একটা করে কাপ।
বিজয়ী ধনু বেপারী সিল্ড হাতে পাওয়া মাত্র উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো দলটা। কিছুক্ষণ পিকেটিং করার পর ডাক-ঢোল বাজিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে করতে বেরিয়ে গেলাে নদী-পথে। আর এক দল বিজয় মিছিল বের করে মেঠো পথে।
রঞ্জুরা জেঠাজীর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।

বড়দের নৌকা বাইশ দেখার পর রঞ্জুদেরও একটা মিনি নৌকা বাইশের আয়োজন করার শখ জাগে। কথাটা মুখে বলা খুব সহজ হলেও কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন। বর্ষাকাল হওয়ায় কারোর নৌকাই অবসর থাকে না।
শেষ পর্যন্ত অনেক খেটেখুটে ছয়টা নৌকা জোগাড় করে তারা। প্রত্যেক নৌকায় মোটমাট মাল্লা থাকবে চারজন। থল্লাও খুব সামান্য। রিন্টুদের ঘাট থেকে খাল পর্যন্ত। ঠিক হয়- আগামী রোববার দুপুরেই নৌকা বাইশ।
নির্দিষ্ট সময়ে নৌকা নিয়ে সবাই রিন্টুদের ঘাটে এসে রিপোর্ট করে। কিন্তু দেখা নেই বাবুলের। না আসার কারণটাও অনুমান করতে পারে না কেউ। দুশ্চিন্তার শেষ নেই! অপেক্ষা করতে করতে প্রায় এক ঘন্টা কাবার। তা সত্ত্বেও তাকে ছাড়া বাইশ শুরু করার ইচ্ছে নেই কারোর।
হঠাৎ নৌকা ছাড়াই হন্তদন্ত হয়ে বাবলু এসে উপস্থিত। তাকে দেখে এগিয়ে যায় সবাই। জিজ্ঞেস করে রঞ্জু-
: কিরে, তোর নৌকা কই? আর এতো দেরী করলি কেন?
কোন জবাব নেই। বাবলের মুখ বন্ধ। কুলুপ আটা। চোখে-মুখে আচার-আচরণে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। এসেই মাথায় হাত দিয়ে ধপাস্ করে বসে পড়ে মাটিতে। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে অসহায় ভঙ্গীতে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থাটা ব্যাখ্যা করে-
: আর বলিস না! নৌকা নিয়ে বের হতে যাবো, অমনি বাজান(বাবা) এসে নৌকায় চড়ে ভাইয়াকে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। ভাবলাম, একটু অপেক্ষা করে দেখি- যদি তারা ফিরে আসেন। কিন্তু আধঘন্টা অপেক্ষা করেও তাদের ফিরে আসতে দেখা গেলো না। বাধ্য হয়ে নৌকা না নিয়েই চলে এলাম। এবার তোরাই বল, আমি কী করতে পারি?
কিচ্ছু করার নেই! শেষমেশ একটা নৌকা কম নিয়েই বাইশ শুরু করে তারা।
পাঁচটা নৌকা নিয়েই ষ্টারটিং পয়েন্টে সারিবদ্ধ হলো সবাই। কেবল রেফারির হুইশেলের অপেক্ষা। রেফারির দায়িত্বটা বাবলুর হাতে। পিচ্চি হলে কি হবে, স্টং প্রিন্সিপলের লোক। স্বজনপ্রীতির ধারে কাছেও নেই।
বাঁশি বাজাবার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বারবার নৌকার অবস্থান দেখে নেয় বাবলু। তারপর- ‘রেডি’ বলে সতর্ক করে সবাইকে। এবার হাতে বাঁধা তালপাতার ঘড়িটার উপর চোখ বুলিয়ে আড়চোখে- একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে- হ্যঁ, সব ঠিক আছে- এমন একটা তৃপ্তির হাসি হাসে।
ঠিক বারটা। এক, দুই, তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে বাম হাত উপরে তুলে বাশিতে ফুঁ দেয় বাবলু। ‘মার টান হেইও’- বলে শুরু হয়ে যায় নৌকা বাইশ।
নৌকাগুলো একশ’ গজও যায়নি, জোসের ঠেলায় রিন্টু আড়ি ছেড়ে বৈঠা টানা শুরু করে মাল্লাদের মতো। ভাগ্য খারাপ! এ ভাবে কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ হাত ফসকে বহুদূরে ছিটকে পড়ে তার বৈঠা। সঙ্গে সঙ্গে রেফারীকে লক্ষ্য করে চিৎকার দিয়ে বাইশ থামার আবেদন করে রিন্টু-
: আমার বৈঠা ছুটে গেছে! বাইশ থামিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
রিন্টুর দাবিটাকে কোন পাত্তাই দিলো না রেফারী। তার এক কথা- বাইশ শুরু হওয়ার পর কার বৈঠা ভাঙ্গলো, কার নৌকায় পানি উঠলো, কার নৌকা ডুবে গেলো- এসব অজুহাত অবান্তর।
তাই বাইশ অব্যাহত রইলো আগের মতো।
তর তর করে এগিয়ে যাচ্ছে সব নৌকা। সীমানা প্রায় দেখা যাচ্ছে। চার জনের মধ্যে পার্থক্যটা খুব সামান্য। বড়জোড় এক হাত। তাই প্রতিযোগীরা সমস্ত শক্তি দিয়ে বৈঠা টানায় ব্যস্ত।
জগলুলদের নৌকার আড়ি ধরেছিলো কুদ্দুস। শেষ মূহুর্তে সেও পিছিয়ে পড়াটাকে কভার করার জন্য আড়ি ছেড়ে বৈঠা টানা শুরু করে। এতে লাভ তো হলোই না বরং ফল দাঁড়ালো উল্টো! আড়ি না থাকায় তাদের নৌকাটা লাইন ছেড়ে রঞ্জুদের নৌকার ঠিক মাঝামাঝি গিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে চরকির মতো ঘুরতে থাকে রঞ্জুদের নৌকাটা। তার পর সোজা ছুটে যায় তীরের দিকে।
এই অবস্থা থেকে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে আসতেই সময় শেষ। বলতে গেলে খালি মাঠেই গোল দিলো মোখলেসরা। সবার আগে তাদের নৌকাটাই পৌঁছে গেলো নির্দিষ্ট সীমানায়।
তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো রঞ্জু-রিন্টুৃ। তাদের দাবী- আজকের নৌকা বাইশ বাতিল করে আর একদিন এটার আয়োজন করতে হবে। কিন্তু এতো চেঁচামেচি, এতো চিৎকার সব বেকার। রেফারী তাদের অভিযোগ নাকচ করে মোখলেসদেরকেই জয়ী ঘোষণা করে দিলো। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে “ফিক ফিক ফোররে” ধ্বনি দিতে লাগলো মোখলেসরা। ধ্বনিটা দেয় রঞ্জুদের একদম মুখের সামনে। রাগে রঞ্জদের মাথার মগজ টগবগ করে ফুটতে থাকে। এতো বড় বেইজ্জতি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু উপায় নেই। সবই ভাগ্য!
এদিকে হাসতে হাসতে কাপটা নিয়ে দুলকি চালে নৌকা টানতে টানতে মোখলেসরা চলে গেলাে উত্তর পাড়ার দিকে।

খেলায় হারলে কোন দুঃখ ছিলো না। কিন্তু এভাবে পরাজয়? উহু! কিছুতেই মানা যায় না। তাই মন খারাপ করে বৈঠকে বসে হারু-পার্টির দল।
রঞ্জু একা নয়, হারু পাট্টির সবার আনন্দটাই মাটি। রঞ্জুর ইচ্ছে হচ্ছিল- কুদ্দুসের গালে কষে একটা চড় লাগায়। আড়ি ফেলে বৈঠা টানার শখটা জম্মের মতো মিটিয়ে দেয়! কী দরকার ছিলো রে বাবা, এতো তাড়াহুড়ু করার! কিন্তু কিছুই করতে পারে না। বন্ধু বলে কথা! আসলে, এ অবস্থায় ভাগ্যকে দোষারূপ করা ছাড়া কি-ই বা করার আছে তাদের?
(চলবে——)

(‘রঞ্জুর ছেলেবেলা’-থেকে)

Related posts

Leave a Comment