কবিরাজি
-কাজী মোঃ হাসান

বৎসরের প্রথম দিকে, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পরপরই স্কুলে বাষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন চলে। সঙ্গে থাকে ভালো ফলাফল করা ছেলে-মেয়েদের উৎসাহ দেয়ার জন্য পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। প্রতি বৎসরই এর আয়োজন করা হয়। এবারও হলো। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিম সাহেব।
ক্লাশে প্রথম হওয়ায় উপহার হিসেবে রঞ্জু পালো একটা বই। নাম ‘চাচা কাহিনী’। আব্বুও দিলেন একটা। বিদেশী গল্পের অনুবাদ-‘লুরা মেরীর গল্প শোন’। খুব মজার বই। বইটার শেষ দিকের ছোট্ট একটা কবিতা আজো রঞ্জুকে নাড়া দেয়-
“দেখে এলাম কত শহর
তেমন কিছু নয়,
হোক না ছোট আমার ঘর
তবু মধূময়।”
জীবনে এত সত্য, এত মধুর কথা, বোধ হয় আর একটাও নেই!
এ ঘটনার পর এক মাসও পার হয়নি। হঠাৎ গোপাল ভট্র্রাচার্য স্যার কাউকে কিছু না জানিয়ে স্কুল বন্ধ করে ইন্ডিয়া চলে যান। ফলে বিপাকে পড়ে কয়েকশ’ ছাত্র-ছাত্রী। চিন্তায় অভিভাবকদের ঘুম হারাম। তখন তো এতো স্কুল কলেজ ছিলো না। তাই এতো চিন্তা। আবার কোথায় যাবেন, কোন স্কুলে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করাবেন- এ চিন্তাটা কি কম? কাছাকাছি বাচ্চাদের ভালো কোন স্কুলও নেই। যা আছে তাও প্রায় মাইল দুই দূরে- ঝাউগাড়া। সেটা আবার সরকারী ফ্রী পাইমারী স্কুল।
শেষ পর্যন্ত সেখানেই ভর্তি হতে হলো সবাইকে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রী মতিলাল ঘোষ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্রী নলীনী ঘোষের সুযোগ্য ভাই। এই স্যারের মতো এতো নীতিবান, এতো দেশ দরদী, এতো স্নেহ বৎসল এবং সৎ মনুষ খুব কমই আছেন। এখানে স্কুলে রঞ্জুরা চার বৎসর লেখাপড়ো করে। এই দীর্ঘ সময়ে স্যার একদিনও স্কুলে দেরিতে এসেছেন বা আগে চলে গেছেন অথবা শিক্ষকতায় ফাঁকি দিয়েছেন, এমনটা রঞ্জু কেন, স্যারের শক্র যদি কেউ থাকে, সেও বলতে পারবে না।

সেকেন্ড টিচার আফাজউদ্দিন সাহেব। মাঝ বয়সি। ভীষণ কড়া মানুষ। একটু এদিক-ওদিক হলেই চড় থাপ্পর তো আছেই, বেতটা হাতের কাছে থাকলে সেটার ব্যবহার করতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

হেকিম মাষ্টার থার্ড স্যার। তিন জনের মধ্যে তিনিই একটু ইয়ং। সবাই বলাবলি করে, তিনি নাকি অসম্ভব ভালো সুটার। তাঁর নিশানা থেকে বাঁচার উপায় নেই কারোর।

সব সময়ই বন্দুকটা সাথে রাখেন। লাইসেন্স করা বন্দুক। হারিয়ে গেলে কিংবা চুরি হলে নাকি বিপদের কোন শেষ নেই! তাই বন্ধুকটা নিয়ে সারাক্ষণ ভীষণ সতর্ক তিনি। একদিন স্যার বললেন, ঘুমের মধ্যেও নাকি লাফ দিয়ে বন্ধুকটা খুঁজেন। ছুঁয়ে দেখেন ওটা ঠিক মতো আছে কি-না! একথা শুনার পর থেকে রঞ্জু মনে মনে ঠিক করে- যে জিনিস নিজের এবং অপরের, এক কথায় মানুষের শান্তি কেড়ে নেয়, তার ধারে কাছেও যাবে না সে।

আর যাই হোক, ছাত্ররা- হকিম স্যারের প্রাণ। তাদের কোন অপরাধই তাঁর কাছে কোন বিষয় নয়। স্যারের দৃষ্টিতে দুষ্টুমি, মারামারি এসব তো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে থাকবেই। তাঁর একটাই কথা-
: ওরা এখনো অবুঝ, বুঝলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!

হঠাৎ করেই একবার এই থার্ড স্যারের হাতের নিশানা দেখার সুযোগ এসে যায় রঞ্জুদের সামনে।
একদিন সবে মাত্র স্কুল ছুটি হয়েছে। এমন সময় একটা শামুকভাঙ্গা পাখি দল-ছুট হয়ে উড়তে উড়তে শনিদের শিমূল গাছের মগডালে গিয়ে বসে। এদিকে দু’জন পুলিশ বন্ধুক হাতে পাখিটার পিছু দৌড়াতে দৌড়তে একদম শনিদের বাড়ি।

খবর পেয়ে ছাত্ররাও ভীড় করে সেখানে। তাদের দেখেই বড়রা সাবধান করে দিলেন-
: এই বাচ্চারা, গোলমাল করবি না। চুপচাপ থাকবি। গোলমাল শুনলেই পাখিটা উড়ে যেতে পারে।
ইতিমধ্যে থার্ড স্যারও এসে হাজির। আর বন্দুক তো সাথে আছেই। স্যারকে দেখে ছাত্ররা আরও বেশী আগ্রহী হয়ে উঠে শুটিং দেখার জন্য। সে এক রোমাঞ্চকর মূহুর্ত!
আগে পুলিশরাই গুলি ছুড়লেন। পরপর পাঁচ রাউন্ড। কিন্তু কেন জানি, একটা গুলিও লাগাতে পারেননি তাঁরা। হয়তঃ পাখিটা অনেক উপরে থাকায় নিশানা ঠিক থাকেনি তাদের!

এর চাইতেও আশ্চর্য অন্য জায়গায়, এতগুলি গুলির আওয়াজ শুনেও পাখিটা উড়ে তো গেলোই না, বরং ঠায় বসে রইলো নির্বিকার ভাবে। হয়তঃ পাখিটা উড়তে উড়তে কাহিল হয়ে গেছে, নয়তো বসে বসে মনে মনে ভাবছে-
: দেখি না, বেটাদের বাহাদুরি কতো!
পাঁচ রাউন্ড গুলি করেও লাগতে না পেরে পুলিশরা হতাশ। হাল ছেড়ে দিলেন তারা। এবার স্যারকে অফার দিলেন-
: স্যার, আমরা শেষ। এবার আপনার পালা। আপনি গুলি ছুড়তে পারেন।
স্যার গুলি ভরে নিশানা তাক করার জন্য বন্দুক উঠালেন।
বন্দুক উঠাতে দেখে রঞ্জুরা উত্তেজনায় আল্লাহকে ডাকতে লাগলো দু’হাত তুলে! তাদের ভয় একটাই, যদি স্যারও লাগাতে না পারেন- তখন কি হবে? স্যারের ইজ্জত মানেই তো তাদের ইজ্জত!

ঠুস্! গুলিটা উড়ে গেলো উপরের দিকে। আওয়াজ হতেই রঞ্জুর চোখ দু’টো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে আসে শঙ্কায়। চোখ খুলে কি দেখবে কে জানে! হঠাৎ হইচই। চোখ খুলে দেখে- এক গুলিতেই পাখিটা ধপাস। লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
সঙ্গে সঙ্গে পাখিটার কাছে ছুটে গেলেন দু’জন লোক। তারা চাকু দিয়ে তাড়াতাড়ি জবাই করে ফেলে পাখিটা।

এবার স্যার পুলিশদের লক্ষ্য করে বললেন-
: ভাই, পাখিটা আপনারা নিয়ে যান।
প্রথম দিকে মৃদু আপত্তি তোলেন তারা-
: আরে না, না। আমরা নেবো কেন। মারলেন আপনি, আর পাখি নেবো আমরা, এটা কি করে হয়!
: কেন হয় না? ধরুন, আমিই নিলাম। এখন এটা আপনাদের উপহার হিসাবে দিচ্ছি।
এবার আর আপত্তি করলেন না তারা। খুশী মনেই পাখিটা নিয়ে চলে গেলেন বন্ধুক কাঁধে ঝুলিয়ে।

(চলবে…………)
০৬/০৮/২০২৩
মিরপুর, ঢাকা।

 

Related posts

Leave a Comment